ফিরে দেখা : ট্রাইব্যুনালে সাকার যত কাণ্ড

রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা সময়ে নানা মন্তব্যের জন্য আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আবার ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালে তিনি কখনো অট্টহাসিতে পুরো এজলাসকক্ষ কাঁপিয়েছেন, কখনো প্রসিকিউটরদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছেন, কখনো খোদ বিচারপতিদেরও হুমকি-ধমকি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনকি ট্রাইব্যুনালের রায়ের দিনেও পুরো সময় বিদ্রূপাত্মক নানা ভঙ্গিতে কথা বলেছেন এই বিএনপি নেতা।

২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার জন্য সকাল ১০টার দিকে সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়।

১০টা ৪১ মিনিটের দিকে তাকে কাঠগড়ায় আনা হয়। কয়েক মিনিট পরই বিচারকরা এজলাসে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রায় পড়া শুরু হয়। ১০টা ৫৩ মিনিটের দিকে রায়ের একপর্যায়ে বলা হয়, ‘হি ওয়াজ ইলেকটেড এমপি ফর ফাইভ টাইমস।’ এ সময় সাকা চৌধুরী বলে ওঠেন, ‘ফাইভ, ফাইভ? নো, সিক্স টাইমস।’ পরে ১১টার দিকে আবার ফাইভ টাইমস বলা হলে তিনি একইভাবে প্রতিবাদ জানান। তখন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুলও দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানও বলেন, ‘সিক্স টাইমস।’ এরপর থেকে রায়ে সিক্স টাইমসই বলা হচ্ছিল। রায়ের শেষের দিকেও একবার সিক্স টাইমস বলা হয়, তখন সাকা চৌধুরী বলেন, ‘বদলানোর দরকার কী? যা লিখছেন তাই থাকুক।’ রায় ঘোষণার সময়ও নানা তির্যক মন্তব্য করেই যাচ্ছিলেন এই বিএনপি নেতা। রায়ের নানা প্রসঙ্গে পাল্টা কথা বলে আসছিলেন তিনি। ব্যঙ্গও করছিলেন মাঝে মাঝে। রায়ের একপর্যায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিচারককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমার বোনকে বিয়ে করার কথা ছিল, সেটা বল না?’ এ কথা বলার পর সাকা চৌধুরীকে ধমক দেন স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী। স্বামীকে ধমক দিয়ে তিনি বলেন, ‘কী বলছো তুমি এসব?’

আবার বিচারক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানোর সময় সাকা বলতে থাকেন, ‘বল বল, কীভাবে ক্যু করছি বল, তোর বোনকে কী করছি বল, ধানের কল চুরি করছি, ঘরে ঢুকছি তারপর কী করছি বল।’ ১১টার পরে রায়ে ১৯৭৩ সালের আইনের কথা বলা হলে সাকা বলেন, ‘কিসের ’৭৩ সালের আইন। এটা ২০০৯ সালে হইছে।’

সাকা বলেন, ‘প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ আমার পক্ষে রায় দেয়। এবার তিনজনের রায় শুনতে এসেছি।’ ১১টা ২৫ মিনিটের দিকে রায়ের একপর্যায়ে নূতনচন্দ্রকে ‘জনপ্রিয়’ বলার পর সাকা বলেন, ‘হ্যাঁ, জনপ্রিয়। তবে মদ বেচত। তার ছেলে সাক্ষী দিয়ে গেছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল। একগাদা ফটোও দেয়া হয়েছে।’ স্বাধীনতার পর নূতনচন্দ্র বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলা সম্পর্কে রায়ে বলা হলে তিনি বলেন, ‘ওই মামলায় কী বলছে? ওই কেসে কি বলা হয়েছে সাকা মেরেছে? বারবার কেন ওই কেসের কথা বলেন? রায়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘হ, সহিহ হাদিস।’

সাকা চৌধুরী তার বিরুদ্ধে অভিযোগে নিজের অবস্থান প্রমাণ করতে পারেননি- এমন একটি কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘১২০০ সাক্ষীর মধ্যে পাঁচজনকে আনতে দিয়েছেন। টেস্টিফাই করবে কেমনে?’

রায়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনসহ পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন আন্দোলনের একটি প্রসঙ্গ এলে তিনি বলেন, ‘এখানেও ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে ছিল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে কোনটা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে, সেটা বের করো।’ পরে তিনি বলেন, ‘নূতনচন্দ্র কোন জায়গা থেকে দেখছে? সে জায়গায় তো ঘরই নেই।’

১১টা ৩৬ মিনিটের দিকে কাঠগড়াসংলগ্ন সামনের সোফায় বসা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন সাকা চৌধুরী। এ সময় তাদের উভয়কে হাসতে দেখা যায়। ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মারা গেছে। তার মধ্যে ২০ লাখ আমি মারছি বলে দিলেই তো হয়। পৌনে ১২টার দিকে আইনজীবীদের সারি থেকে উঠে আসেন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম। তিনি সাকার কাঠগড়া এবং তার স্ত্রী-স্বজনদের সোফার মাঝ দিয়ে বের হয়ে যান। বের হওয়ার সময় উভয় দিকে কথা বলেন তিনি। এ সময় তাজুল বলেন, ‘ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড মিলে যাচ্ছে।’ তখন সাকা বলেন, ‘পুরো রায়ই অনলাইনে এসেছে। এখন আর পড়ার দরকার কী? চলেন বাড়ি যাই।’ বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী উচ্চ স্বরে বলেন, ‘এগুলো পড়ার দরকার নাই, এগুলো তো গত দুই দিন ধরে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।’ এ সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য বিচারক রায় পড়া বন্ধ রাখেন। মিনিট খানেক পর আবার রায় পড়া শুরু করেন তিনি। এর আগে হাসতে হাসতে নিচু কণ্ঠে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ‘যেটা পড়া হয়নি সেটা পড়েন, পড়ে চলেন বাড়ি যাই।’ পরে সাকা আবার বলেন, ‘জাতিসংঘে পর্যন্ত বলে আসছে, দেশীয় আইনে বিচার হবে। এখন আন্তর্জাতিক আইনের কথা বলতেছে। কুলাইতে পারতেছে না।’ ১২টার দিকে তিনি বলেন, ‘রায়ে এমন সব পাড়ার নাম বলতেছে, আমার জীবনেও সেখানে যাই নাই। নির্বাচনের ভোট চাইতেও যাই নাই। জানি তো হিন্দুরা ভোট দিবে না, গিয়ে লাভ কী?’ পরে আবার বলেন, ‘তারা বলছে, সাক্ষী পাঁচজন। এখন বলছে, সাক্ষী আনতে পারি নাই।’

রায়ে লুটের একটি বর্ণনা এলে সাকা বলেন, ‘দেখেন দেখেন কী বলে? ধানের কলও চুরি করছি। আহারে এত অভাবী ছিলাম।’ সাড়ে ১২টার দিকে তিনি বলেন, ‘বলেন ফাঁসির আদেশ হইতে আর কত? ‘গিল্টি, নট গিল্টি’ পড়া শুরু হলে সাকা বলেন, ‘দিয়ে দাও ফাঁসি তাড়াতাড়ি।’

আবার সাকা বলেন, ‘সাঈদী সাহেবের মতো একটা লোককে তোমরা ফাঁসি দিয়ে দিয়েছো। আর আমি তো বড় গুনাহগার। কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিয়েছো কসাই মোল্লা হিসেবে। আর আমাকে তো দিতে হবে ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে। আমি কোন সংগঠনের সদস্য ছিলাম না। আমার দোষ হলো, আমি ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে।’ রায়ের শেষ দিকে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, ‘উই অবজার্ভ।’ তখন সাকা বলেন, ‘আই অলসো অবজার্ভ।’ এ সময় সাকার স্ত্রী বলেন, ‘উই অলসো অবজার্ভ।’

দুপুর ১টা ১০ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ ঘোষণার পর হেসে দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘উই আর সারপ্রাইজড।’ এর পরই চেয়ারের দুই হাতলে দুই হাত রেখে পেছনে হেলান দেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাথাটা ছেড়ে দেন বাঁ কাঁধে। এ সময় এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। ফাঁসির রায়ে হাসি উবে যায় সামনের আসনে বসে থাকা তার স্বজনদেরও। সাকার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী, বড় ছেলের বউসহ আরো দুজন নারী ওই সারিতে বসা ছিলেন। এ সময় জামায়াত নেতাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সাকার স্ত্রীর কাছে গিয়ে সাকা চৌধুরীকে প্রতিক্রিয়া জানানোর অনুরোধ করতে বলেন। পরক্ষণেই মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী তার বাবাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বাবা, দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে তুমি তোমার রি-অ্যাকশন বলো।’ জবাবে সাকা বলেন, ‘বলছি তো মা। আর কত বলব?’ স্ত্রীও তাকে একই অনুরোধ জানালে তিনি হাতে ইশারা করে তাদের কথা বলতে নিষেধ করেন। একপর্যায়ে সবার অনুরোধে তিনি বলেন, ‘এই রায় মিনিস্ট্রি থেকে বের হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দিলাম।’ পরে ১টা ২০ মিনিটের দিকে সাকা চৌধুরীকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে আনেন পুলিশ। সাকাকে নিচে এনে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রাখা হয়। ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে তাকে প্রিজন ভ্যানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

আজ বুধবার আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় অবশেষে ফাঁসির কাষ্ঠেই ঝুলতে যাচ্ছেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত এই বিএনপি নেতা।



মন্তব্য চালু নেই