প্রেমের টানে কাঁটাতার পাড়িঃ পম্পার প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়াল সীমানা। একটি করুন প্রেমকাহিনী

প্রেমের টানে কাঁটাতারের বাধা পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের তরুণী পম্পা মণ্ডল। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের আমজাদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। দুজনে ঘর বাঁধেন। কিন্তু কাঁটাতারের সীমানা বাধা হয়ে দাঁড়াল তাঁদের জীবনে। বিনা পাসপোর্টে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার দায়ে আদালত তাঁকে ১৫ দিনের সাজা দেন। কারাভোগ শেষে আজ সোমবার সকাল আটটার দিকে তিনি নিজ দেশ ভারতের পথে পাড়ি দিয়েছেন।

কুষ্টিয়া কারাগার থেকে বের হওয়ার পর পম্পা মণ্ডলকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমা‌ন্তে নেওয়া হয়। সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মাধ্যমে তাঁকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

কারাগার থেকে বের হয়ে পম্পা মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইন্ডিয়া আমার কাছে ভালো লাগে। তার পরও আমজাদকে ভালো লেগেছিল। বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু এখন ভাগ্যের লিখনে দেশে চলে যেতে হচ্ছে।’

কুষ্টিয়া কারাগারের কারা তত্ত্বাবধায়ক মকলেছুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, পম্পা মণ্ডলের ১৫ দিনের সাজা হয়েছিল। এরপর তাঁকে দেশে পাঠানোর ব্যাপারে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হয়। গত সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন সরকারি সফরে ভারতে গিয়ে পম্পা মণ্ডলকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি জানান। এ সময় জানানো হয়, দর্শনা সীমান্তে পম্পার পরিবার তাঁকে নিতে আসবে।

সকালে কারাগারে গিয়ে দেখা গিয়েছে, কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের নারী সদস্যসহ পাঁচ সদস্যের একটি দল পম্পাকে গাড়িতে করে কুষ্টিয়ার পোড়াদহ রেলস্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে ট্রেনে করে তাঁকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় নেওয়া হবে। এরপর তারা তাঁকে দর্শনা সীমা‌ন্তে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করবে।

পম্পা মণ্ডলকে ভারতে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা ‘সংলাপ’ ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) কাজ করেছে। ব্লাস্ট, পুলিশ ও কুষ্টিয়া কারাগার সূত্রে জানা গিয়েছে, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ গ্রামের আমজাদ আলীর সঙ্গে পম্পার কয়েক বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পম্পার বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরুটিয়া থানার শিকারপুর গ্রামে। গত ১৪ মে তিনি বাড়ির পাশের হাঁটুপানির মাথাভাঙ্গা নদী পাড়ি দিয়ে আমজাদের কাছে আসেন। দুজনে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন।

পম্পা বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পরপরই তাঁর বড় ভাই অনুপ মণ্ডল স্থানীয় মুরুটিয়া থানায় আমজাদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। একই সঙ্গে তিনি কলকাতায় সংলাপ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনকে বিষয়টি জানান। পরে সংলাপ কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিকে জানিয়ে পম্পাকে উদ্ধারে সহায়তা কামনা করে। ২৪ দিন সংসার করার পর মানবাধিকারকর্মীদের সহায়তায় পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তাঁকে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার দায়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। বিনা পাসপোর্টে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার দায়ে আদালত তাঁকে ১৫ দিনের সাজা দেন।

কারা তত্ত্বাবধায়ক মকলেছুর রহমানের ভাষ্য, সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। গত ৯ নভেম্বর দর্শনা সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাঁর পরিবার না আসায় তাঁকে ফেরত না পাঠিয়ে আবার কারাগারে নেওয়া হয়েছিল।

প্রেমের টানে কাঁটাতার পাড়ি, বিয়ে, অতঃপর কারাগারে

এপারে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ গ্রাম, ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরুটিয়া থানার শিকারপুর গ্রাম। মাঝখানে হাঁটুপানির মাথাভাঙ্গা নদী।

ধর্মদহের আমজাদ আলী আর শিকারপুরের পম্পা মণ্ডলের পরিচয় হয় চার বছর আগে। এরপর মাথাভাঙ্গার দুই পাড়ে মাঝে মাঝে দেখা। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত।

এভাবেই কাটে চারটি বছর। এরপর গত ১৪ মে পম্পা নদী পার হয়ে আমজাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। পরে আমজাদ পম্পাকে বাড়িতে নিয়ে যান। বিয়ে করে শুরু করেন সংসার।

গতকাল রোববার দুপুরে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের সহায়তায় পুলিশ পম্পাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তাঁকে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার দায়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

প্রেমিক আমজাদ আলী জানান, বছর চারেক আগে তিনি নদী পার হয়ে শিকারপুর গ্রামে দুর্গাপূজা দেখতে যান। সেখানে অনুপ মণ্ডলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় হয় অনুপের একমাত্র ছোট বোন পম্পা মণ্ডলের সঙ্গেও। পম্পা স্থানীয় করিমপুর পান্না দেবী কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমজাদ পম্পাকে একটি বাংলাদেশি মোবাইল ফোনের সিম কিনে দেন। সব সময় দেখা না হলেও মোবাইল ফোনে তাঁদের সম্পর্ক দিন দিন গভীর হয়।
গত ১৪ মে পম্পা কাঁটাতার পেরিয়ে আমজাদের কাছে ছুটে আসেন। তিনি তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যান। দুদিন পর মেহেরপুর শহরে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি কাজি অফিসে পম্পার নাম (আমেনা খাতুন) পরিবর্তন করে বিয়ে করেন আমজাদ। এরপর তাঁরা আমজাদের বাড়ি ফিরে আসেন।

এদিকে পম্পা বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পরপরই তাঁর বড় ভাই অনুপ মণ্ডল স্থানীয় মুরুটিয়া থানায় আমজাদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। পাশাপাশি তিনি কলকাতায় সংলাপ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনকে বিষয়টি জানান। পরে সংলাপ কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিকে জানিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধারে সহায়তা কামনা করে। সমিতির কুষ্টিয়া অফিসের কর্মীদের সহায়তায় পুলিশ অনুপ্রবেশের অভিযোগে পম্পাকে গতকাল আমজাদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কুষ্টিয়া কারাগারে পাঠায়।

জানতে চাইলে আমজাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি যা বলে বোঝাতে পারব না। এটা বিধাতার দান। আমি তাকে বিয়ে করেছি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও হয়েছে। কোনো সিস্টেম থাকলে আমি কারাগারে গিয়ে ওঁর সঙ্গে থাকতে চাই। যেকোনো মূল্যে আমি পম্পাকে ফেরত চাই। এর জন্য আমি আইনি লড়াই করতে প্রস্তুত।’

যোগাযোগ করা হলে পম্পার বাবা অসিত মণ্ডল মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যেকোনো উপায়ে একমাত্র মেয়েকে ফেরত চান। মেয়ে ভুল করেছে। প্রেমের বিষয়টি তিনি জানতেন না। তিনি আরও জানান, আগামী আগস্টে পম্পার প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা। এর আগেই মেয়েকে ফেরতের আকুতি জানান তিনি।
পম্পার বরাত দিয়ে মহিলা আইনজীবী সমিতির কুষ্টিয়ার প্রকল্প কর্মকর্তা আইনজীবী কামরুন্নাহার প্রথম আলোকে জানান, ‘মেয়েটি ছেলেটিকে অসম্ভব ভালোবাসে। সে এই দেশেই থাকতে চায়। তবে সে (পম্পা) এক পর্যায়ে জানায়, মোবাইল ফোনই তার সর্বনাশ করেছে। এখন সেই ভুল শোধরাবার কোনো উপায় নেই বলে জানায়। যা হবার হয়ে গেছে। সে সংসার করতে চায়।’

কামরুন্নাহার বলেন, আমজাদকে ভণ্ড মনে হয়েছে। পম্পাকে আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাঁকে আইনি প্রক্রিয়ায় কারাগার থেকে বের করে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

দৌলতপুর উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ধর্মদহ গ্রামের বাসিন্দা রুস্তম আলী বলেন, আমজাদ এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আর লেখাপড়া করেনি। তাঁর পরিবারের অবস্থাও ভালো না। ছেলেটি ডানপিটে স্বভাবের। তাঁর বাবার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে।



মন্তব্য চালু নেই