প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তক ভুলে ভরা

প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের মলাট ঝকঝকে হলেও, ভেতরে ছাপার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এর বর্ণ পরিচয় অংশে ‘ওড়না’ বিতর্ক, পঞ্চম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ এবং ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’- বইয়ে বানান ভুল, অষ্টম শ্রেণির ‘আনন্দ পাঠ’-এ ‘ছাগল আম খায়’-এর মতো হাস্যকর তথ্য রয়েছে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে পদ্য ‘বিকৃত’ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনা। এদিকে এসব ভুল বিষয়ে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন শিক্ষাবিদ। পাশাপাশি ভুলের কারণ খতিয়ে দেখারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।

পঞ্চম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ের ‘নির্দেশনা’র উপশিরোনাম ‘পড়া’য় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পঞ্চম শ্রেণি শেষে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত পর্যায়ে পড়ার দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের যেসব দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন তা হলো: শুদ্ধ, স্পষ্ট ও প্রমিত উচ্চারণে পড়া।’ আর এ বিষয়টি মাথায় রেখে বইগুলো পরিমার্জন করা উচিত ছিল মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ২০১৩ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই বার বার পরিমার্জনের পরও এ ধরনের ভুল থাকা ঠিক হয়নি।

পঞ্চম শেণির ‘আমার বাংলা বই’-এর ২৭ পৃষ্ঠায় ‘যান নি’, ৪৬ পৃষ্ঠায় ‘আসেন নি’সহ অন্যান্য পৃষ্ঠায় এ ধরনের ভুলে ছড়াছড়িকে বড় ধরনের ভুল বলে অভিহিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. বিশ্বজিত ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘প্রমিত বানান রীতি অনুযায়ী ‘নি’ আলাদা হবে না। প্রমিত বানান রীতি অনুযায়ী যাননি, আসেননি লিখতে হবে।’’

পঞ্চম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ২ নম্বর পৃষ্ঠার এক অধ্যায়ের ২০ নম্বর লাইনে ‘ঘোষণা’ বানান লেখা হয়েছে ‘ঘোষনা’। এই বানানটিও বড় ধরনের ভুল বলে অভিমত দেন বিশ্বজিত ঘোষ।

বইটির সংকলন, রচনা ও সম্পাদনায় হায়াৎ মামুদের নাম রয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ণ-ত্ব বিধি অনুযায়ী ‘ষ’-এর পর কখনও ‘ন’ হয় না। এটি ভুল। ঘোষণা বানানে ‘ণ’ হবে।’’

এছাড়া বইটির অনেক জায়গায় এমন বানান ভুল রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. বিশ্বজিত ঘোষ বলেন, ‘কোনও কারণে ভুল হতে পারে। সব ভুল শনাক্ত করে, তা পরিমার্জনের মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে।’

অষ্টম শ্রেণির ‘আনন্দ পাঠ’ বইটিতে সংকলিত গল্প প্রসঙ্গে অভিভাবকরা বলেন, এই বইয়ের সব গল্পই বিদেশি গল্পের অনুবাদ। কোনও দেশি ভাষায় লেখা গল্প নেই। এই বইয়ে অন্তত একটি দেশি ভাষায় লেখা মৌলিক গল্প থাকা উচিত ছিল বলে অভিমত দেন বিশেষজ্ঞরা। বইটির ১১ পৃষ্ঠায় ‘অ’-তে ‘অজ’ (ছাগল) লেখা হয়েছে। ‘অ’ চেনাতে ‘ছাগলে আম খায়’ লেখা হয়েছে। বিষেজ্ঞদের মতে, ‘ছাগল আম খায়, এ ধরনের ছবি (অলঙ্করণ) ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। ‘ছাগল আম খায়’—এমনটি সচরাচর চোখে পড়ে না।

এ বিষয়ে হায়াৎ মামুদ বলেন, ‘কথায় আছে, ছাগলে কিনা খায়। ‘আনন্দ পাঠ’ বইয়েল মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তো আনন্দও দিতে হবে।’

তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এ কুসুমকুমারী দাশের লেখা ‘আদর্শ ছেলে’ পদ্যটি বিকৃত করা হয়েছে। মূলে আছে ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’ অথচ বইয়ে ছাপা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?’ মূলে আছে ‘‘মানুষ হইতে হবে’—এই তার পণ’’। ছাপানো হয়েছে ‘মানুষ হতেই হবে’। মূলে আছে ‘হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান’। ‘খাট’ শব্দটিকে বিকৃত করে লেখা হয়েছে ‘খাটো’।

এই কবিতার বিকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. বিশ্বজিত ঘোষ বলেন, ‘এগুলো ভুল। মূল কবিতার বাইরে যা কিছু করা হয়েছে, তার সবই ভুল।’

প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এ বর্ণ পরিচিতি অংশের ‘পাঠ ১২’-এ ‘ও’ বর্ণ চেনানোর উপকরণ হিসেবে ‘ওড়না’ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘শুনি ও বলি’ পাঠ অংশে ‘ও’ বর্ণ চেনানোর জন্য ওড়না পরা কন্যাশিশুর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে—‘ওড়না চাই’। এ বিষয়ে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমেদ আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘শিশুদের জন্য এটি করা ঠিক হয়নি।’

এদিকে বই কাটিং করতে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবই ‘ইংলিশ ফর টুডে ক্লাস ফাইভ’-এর পাতাগুলো ওপরের দিক থেকে এমনভাবে কেটে ফেলা হয়েছে, তাতে প্রতিপৃষ্ঠায় থাকা প্রতীক ও লেখাও কেটে গেছে। এছাড়া ছাপা এতই নিম্নমানের যে, বইটির পৃষ্ঠানম্বর, বর্ণ ও অলঙ্করণগুলো স্পষ্ট বোঝা যায় না। একই অবস্থা পঞ্চম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়েরও। এই বইটির এক পৃষ্ঠার লেখা অন্য পৃষ্ঠা থেকে দেখা যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার পাঠ অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এতে পড়তে অসুবিধা হচ্ছে বলে অভিভাবকরা জানান।

এ ধরনের সব ভুল, অসঙ্গতি ও বিকৃতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান নারায়ণচন্দ্র সাহা বলেন, ‘ভুল পাওয়া গেলে পরিমার্জনের সময় ঠিক করা হবে। আমাদের কমিটির কাছে বিষয়টি জানতে চাইব, কমিটি দেখবে।’ নিম্নমানের ছাপার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছাপা যদি নিম্নমানের হয়, তাহলে তাদের বিল আটকে দেওয়া হবে।’



মন্তব্য চালু নেই