প্রাণের বইমেলার পর্দা উঠছে আজ

আবার এসেছে ফেব্রুয়ারি- অমর একুশের স্মৃতিবিজড়িত মাস। আজ প্রথম দিন। এ মাস এলেই বাতাসে ভেসে আসে একুশের আনন্দ-বেদনামাখা উৎসবের সৌরভ। একুশে মানে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি- রক্তের অক্ষরে লেখা একটি অমর কবিতা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদ বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করেছিলেন এই অমর কবিতা। সেদিন তাদের আত্মদানের মহান সংগ্রামের ফলেই বাংলা পেয়েছে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। আর এই একুশের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সারা বিশ্বে নানা পরিসরে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে এ মাসেই প্রতি বছর বাংলা একাডেমি চত্বরে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা- আমাদের প্রাণের মেলা। উৎসব আয়োজনে লেখক-প্রকাশকদের সরব পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে একাডেমি চত্বর। ভেসে আসে ভাঁজখোলা নতুন বইয়ের প্রাণজুড়ানো সুবাস।

আজ বুধবার (০১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রন্থমেলা ও চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। এরপর তিনি মেলা পরিদর্শন করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এবার বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত বিদেশি অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন চীনের প্রখ্যাত গবেষক ও রবীন্দ্র অনুবাদক ডং ইউ চেন, অস্ট্রিয়ার মেনফ্রেড কোবো, পুয়ের্তোরিকোর লুস মারিয়া লোপেজ, ভারতের চিন্ময় গুহ প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি প্রফেসর ইমেরিটাস আনিসুজ্জামান। এ অনুষ্ঠানেই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬ প্রদান করা হবে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত মীর মোশাররফ হোসেনের অমর সৃষ্টি ‘বিষাদ সিন্ধু’র অনুবাদ ‘Ocean of Sorrow’ এবং জার্মানি থেকে প্রকাশিত ‘Hundred Poems from Bangladesh’ তুলে দেয়া হবে। অন্যদিকে এদিন আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচিত প্রবন্ধ।

আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন : অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে আয়োজিত চার দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২ ফেব্র“য়ারি দেশের ছয়জন বিশিষ্ট লেখক-বুদ্ধিজীবীকে ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন লেখক সম্মাননা-২০১৭’ প্রদান করা হবে। তারা হলেন জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। সম্মেলনে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চীন, রাশিয়া, পুয়ের্তোরিকো, থাইল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশের বিশিষ্ট কবি-কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করবেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম ও ত্রিপুরা থেকেও কবি-লেখকরা সম্মেলনে অংশ নেবেন।

এছাড়া অস্ট্রিয়া থেকে মেনফ্রেড কোবো, জার্মানি থেকে ইওনা বুরঘার্ট, টোবিয়াস বুরঘার্ট, পুয়ের্তোরিকোর লুস মারিয়া লোপেজ ও মারিয়া ডি লোস অ্যানজেলেস পোগাদাইভ, চীনের অধ্যাপক ডং ইউ চেন, রাশিয়ার ড. ভিক্টর আলেক্সান্দ্রোভিচ পোগাদাইভ এবং ভারতের পবিত্র সরকার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, চিন্ময় গুহ, শ্যামলকান্তি দাশ, সুবোধ সরকার, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সাধন চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, সুনন্দা সিকদার ও ইমানুল হক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন।

মূলত সম্মেলন উদ্বোধনের পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে তিন দিনের বিভিন্ন অধিবেশন। এসব অধিবেশনের বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকবে কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ-সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য, অনুবাদসাহিত্য, নাট্যসাহিত্য, শিশু-কিশোর সাহিত্য ও ফোকলোর। সম্মেলনে বাংলাদেশ ও ভারতের লেখকদের উপস্থাপিত প্রবন্ধগুলোর সংকলন যুগপৎ ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হবে। সম্মেলনের একটি বিশেষ অংশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কবিদের কবিতা পাঠ করা হবে।

মেলা চত্বর : এ বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মোট ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ১১৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪৯টি ইউনিট- মোট ৪০৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬৩টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমিসহ মোট ১৫টি প্রকাশনীকে ১৫টি প্যাভিলিয়ন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মেলার দক্ষিণ পাশে ১০০টি লিটল ম্যাগাজিন স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মেলায় বাংলা একাডেমির বই ৩০ শতাংশ ও অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ ছাড় দেয়া হবে। প্রতিবারের মতো এবারো শিশু কর্নার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকবে। এসবের বাইরেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পর্যাপ্ত মাটি ফেলে জমি ভরাট করা হয়েছে। প্রায় ৮০ হাজার বর্গফুট এলাকায় ইট ও বালু দিয়ে অস্থায়ী রাস্তা/উন্মুক্ত প্রান্তর নির্মাণ করা হয়েছে। শিশু কর্নারে এবার নতুন সংযোজন ‘মাতৃদুগ্ধ সেবাকেন্দ্র’। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

গ্রন্থমেলা উপলক্ষে আজ থেকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী চত্বরে গেলে দেখা মিলবে লেখক-প্রকাশকদের প্রাণবন্ত আড্ডা। এ গ্রন্থমেলা নিয়ে বাংলা একাডেমি চত্বর মুখর থাকবে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস।

আজ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে। মেলা উপলক্ষে আজ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় মেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

পুরস্কার : বরাবরের মতো এবারো মেলায় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে। এছাড়া তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’, শিশুতোষ গ্রন্থের গুণগত মান বিচারে একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে। এছাড়া মেলার শেষ দিন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হবে।



মন্তব্য চালু নেই