প্রথম চন্দ্র জয়ের গল্প

চন্দ্রজয় নিয়ে গল্প লেখা শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষের অবতরণের অনেক আগে থেকেই। ১৮৬৫ সালে জুলভার্ন লেখেন ‘ফ্রম আর্থ টু দি মুন’। তার এই কল্পকাহিনীতে একটি মহাকাশযান আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে যাত্রা শুরু করে চাঁদে অ্যাডভেঞ্চার করে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে। ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয় এইচজি ওয়েলস-এর ‘দি ফার্স্ট ম্যান অন দ্য মুন’। এই গল্পে মানুষেরা এক ধরনের পদার্থ ব্যবহার করে, যা নাকি নিজে থেকেই বাতাসে ভাসতে পারে।

আইজাক আসিমভ একটি কল্পকাহিনী লেখেন ১৯৩৯ সালে। আর কাহিনী অনুযায়ী ঘটনা ঘটে ১৯৬৯ সালে। আর্থার সি ক্লার্কও লিখেছিলেন ১৯৫১ সালে। নাম ‘প্রিলিউড টু স্পেস’। এ ছাড়াও আরও অনেকেই চাঁদে অভিযান নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। এসব লেখা বই থেকে তৈরি হয় চলচ্চিত্রও। জুলভার্নের ‘ফ্রম আর্থ টু দি মুন’ থেকে তৈরি হয় নির্বাক চলচ্চিত্র ‘এ ট্রিপ টু দি মুন’। চলচ্চিত্রটি ১৯০২ সালে মুক্তি পায় আর মানুষ স্বাদ পায় চন্দ্রজয়ের। বাস্তবে মানুষ চাঁদে যায় আরও অনেক পরে।

চাঁদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরুও খুব বেশি দিনের নয়। ১৬০৯ সালে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও সে যুগের তুলনায় মোটামুটি উন্নত একটি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। তার উদ্ভাবিত এই টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি প্রথম চাঁদের পৃষ্ঠতল দেখতে পান। এটাই আসলে চাঁদ নিয়ে সর্বজন স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরু। গ্যালিলিওর পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরা চাঁদ নিয়ে আরও গবেষণা করেন।

সত্যিকারভাবে বলতে গেলে চাঁদে প্রথম অভিযান শুরু করে আসলে রাশিয়া। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বাইরে প্রথম প্রাণী (লাইকা নামের একটা কুকুর), প্রথম পুরুষ নভোচারী (ইউরি গ্যাগারিন), প্রথম নারী নভোচারী (ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভা) পাঠানোর কৃতিত্বও তাদের। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘লুনা ২’ মিশন হচ্ছে চাঁদে অবতরণকারী মনুষ্যনির্মিত প্রথম বস্তু যা ১৯৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদে অবতরণ করে।

তারা ১৯৫৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লুনা-২ নামের একটি নভোযান পাঠায় চাঁদের উদ্দেশে। এ নভোযান চাঁদের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে চাঁদের উল্টো পৃষ্ঠের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। মূলত তারপর থেকেই চাঁদের বুকে মানুষ পাঠাতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে। কিন্তু রাশিয়ার মহাকাশ অভিযান নিয়ে অনেক অর্জন থাকলেও চাঁদের বুকে প্রথম মানুষ পাঠানোর প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় আমেরিকা।

চাঁদে মানুষের প্রথম সফল অবতরণ ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই ১০:৫৬ পিএম, যা স্থানাংকিত আন্তর্জাতিক সময় বা ইউটিসি (Coordinated Universal Time) সময় অনুযায়ী ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই ০২:৫৬। মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখেন। দিনটি মানবসভ্যতার জন্য চিরস্মরণীয় একটি দিন।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ এর মধ্যে চাঁদের বুকে ছয়বার মানুষের অবতরণ ঘটে। পৃথিবী থেকে নীল আর্মস্ট্রংদের যাত্রা শুরু হয় ১৬ জুলাই ১৯৬৯ অ্যাপোলো-১১ নামের রকেটে চেপে। আর্মস্ট্রংয়ের সহযাত্রী ছিলেন মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অ্যাপোলো-১১ এর দু’টি অংশের একটি কমান্ড মডিউলের নাম রাখা হয়েছিলো কলম্বিয়া। এই নামটি জুলভার্নের কল্পকাহিনী ‘ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন’ থেকে নেওয়া।

অভিযাত্রীরা যখন যাত্রা শুরু করেন, তখন স্থানীয় সময় সকাল ৯টা বেজে ৩২ মিনিট। নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারের চারপাশে তখন হাজার হাজার উৎসাহী মানুষের ভিড়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রকেট পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে যায়। ততক্ষণে কেটেছে মাত্র বার মিনিট। এর পরই শুরু হলো মূল অভিযান, চাঁদের অভিমুখে যাত্রা।

দীর্ঘ যাত্রা শেষে ১৯ জুলাই অ্যাপোলো-১১ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করলো। আগেই ঠিক করা ছিল চন্দ্রযানের প্রথম অংশ কমান্ড মডিউল চাঁদের কক্ষপথে থাকবে কিন্তু চাঁদের মাটিতে নামবে না। অপর অংশ লুনার মডিউল নামবে চাঁদের মাটিতে।

আমেরিকার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে লুনার মডিউল ঈগল থেকে প্রথমে চাঁদের বুকে পা রাখেন মিশন অধিনায়ক নীল আর্মস্ট্রং। বিভিন্ন রকম শিলা সংগ্রহ করলেন, অসংখ্য ছবি তুললেন। নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে নামার সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর অলড্রিনও নেমে আসেন। তিনিও ছবি তোলা, শিলা সংগ্রহ করে আড়াই ঘণ্টা পর ফেরার উদ্যোগ নেন। দু’জনেই দুই ব্যাগে করে নিয়ে নেন সাড়ে একুশ কেজি ধুলো-বালি, পাথর ইত্যাদি।

চাঁদের অতিথিরা চাঁদে রেখে আসেন কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, আমেরিকার পতাকা, পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের মানচিত্র, একটি সিলিকন মেসেজ ডিস্ক যার মধ্যে রেকর্ড করা আছে পৃথিবীর ৭৩টি দেশের প্রধানসহ আমেরিকার কয়েক প্রেসিডেন্টের বাণী।

২৪ জুলাই চন্দ্র বিজয়ীরা পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ওয়েক দ্বীপ থেকে প্রায় ২৬৬০ কিলোমিটার পূর্বে সাগরে অবতরণ করেন তারা। উদ্ধারকারী জাহাজ মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হর্নেট তাদের অবতরণ স্থল থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে ছিলো। হেলিকপ্টারের সাহায্যে তাদের ইউএসএস হর্নেটে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্য দিয়েই শেষ মানুষের প্রথম চন্দ্র অভিযান।

চাঁদে অবতরণ মানব ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। এ বছর চাঁদে অবতরণের ৪৬ বছর পূর্ণ হলো। আজ আমরা মানব ইতিহাসের এই অবিস্মরণীয় ঘটনাকে গর্বের সঙ্গে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি সেদিনের সাহসী অভিযাত্রীদের।



মন্তব্য চালু নেই