প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পর ‘দিগ্‌ভ্রান্ত’ যুবদল

প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পর ‘দিগ্‌ভ্রান্ত’ হয়ে পড়েছে রাজপথে বিএনপির সবচেয়ে আস্থার সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল। বিএনপির দুই দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে এ সংগঠনটির উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। চরম অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যুবদলের ঐক্য ভেঙে এখন খানখান। ত্যাগী নেতাদের দলে জায়গা না হওয়া, আর সর্বোপরি সংগঠনটি দীর্ঘদিন পুনর্গঠন না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

মঙ্গলবার ২৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছরে পদার্পণ করবে সংগঠনটি। পথচলার এই দীর্ঘ সময় পর বিএনপির আন্দোলনের ‘প্রাণশক্তি’ হিসেবে পরিচিত যুবদলের এখন ত্রাহি অবস্থা। বেশ কয়েকবার সংগঠনের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও সেই প্রক্রিয়া ঝিমিয়ে পড়ায় ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে পড়েন নেতা-কর্মীরা। বাড়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধও। তবে দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে যুবদলের নতুন কমিটি হওয়ার খবরে সরব হতে শুরু করেছেন নেতা-কর্মীরা। ইতিমধ্যে দৌড়ঝাঁপও শুরু হয়েছে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে।

২০১০ সালের ১ মার্চ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে সভাপতি ও সাইফুল আলম নীরবকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরে ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া ২০১ সদস্যবিশিষ্ট যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দেন। এই কমিটির মেয়াদ দুই বছর আগেই শেষ হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরপর দুটি সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুবদলের ভূমিকায় খুশি নন স্বয়ং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আন্দোলনে বিএনপির আস্থার এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মাঠে পাওয়া যায়নি। সে কারণে বিভিন্ন সময়ে নেত্রীর ভর্ৎসনাও শুনেছে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড চলতি বছরের শুরুতে আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ায় সবার আগে যুবদলের কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই সংগঠনটিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। তবে এবার অবধারিতভাইে বিএনপি এবং এর সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে পুনর্গঠনের আওতায় আনা হচ্ছে। মূলত তড়িঘড়ি না করে ধীরেসুস্থে দেখেশুনে যোগ্যকে নেতৃত্বভার দিতে চান বিএনপির প্রধান, যেন কোনোভাবেই অতীতের পুনরাবৃত্তি না হয়।

দলীয় সূত্রমতে, খালেদা জিয়া দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে যুবদলকে পুনর্গঠন করতে সংগঠনটির দায়িত্বে থাকা নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। গত এক মাসেরও বেশি সময়ে লন্ডনে চোখের চিকিৎসার পাশাপাশি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে।

তবে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় না থাকলেও পুনর্গঠনের খবরে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ‘অযোগ্যরা’। সে জন্য আত্মগোপনে থাকা নেতাদেরও কেউ কেউ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন। ভিড় করছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাসায়। লন্ডনে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।

তবে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা বলছেন, যুবদল পুনর্গঠনে অতীত আন্দোলনের ব্যর্থদের আনা হলে তা বিএনপির ‘নিজের পায়ে কুড়াল মারা’র মতো অবস্থা হবে। তাদের মতে, ভবিষ্যতে বিএনপিকে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড় করাতে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে নিবেদিতপ্রাণ, মেধাবী, যোগ্য নেতাদের দায়িত্ব দিতে হবে। অতীতের মতো সিন্ডিকেট করে অযোগ্য ও সুযোগসন্ধানীরা যাতে শীর্ষ নেতৃত্বে আসতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে দলের হাইকমান্ডকে। তা না হলে ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলন আবারও মুখ থুবড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা ওই নেতা-কর্মীদের।

তবে যুবদলের বর্তমান কমিটির নেতাদের বড় একটি অংশই চান যুবদল থেকেই নেতৃত্ব আসুক। অন্যথায় তাদের বিদ্রোহ করার শঙ্কাও রয়েছে বলে জানান তারা। নেতৃত্ব ঠিক করার আগে এই বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুবদলের নতুন কমিটির শীর্ষ দুই পদের জন্য সম্ভাব্য নেতাদের যোগ্যতা পর্যবেক্ষণ করছেন বিএনপির হাইকমান্ড। সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছেন প্রাক্তন ছাত্রনেতা সানাউল হক নীরু, বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, প্রাক্তন ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান রতন, যুবদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব প্রমুখ।

তবে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা ‘এক নেতার এক পদ’ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এই উক্তির পক্ষে মতামত দেন। সে জন্য খায়রুল কবির খোকনকে নরসিংদী জেলা বিএনপির দায়িত্বেই দেখতে চান বিএনপি নেত্রী। তা ছাড়া, তার স্ত্রী মহিলা দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা এবার ওই সংগঠনের সভানেত্রী হতে পারেন। একই পরিবারের দুজন দুই সংগঠনের শীর্ষ দায়িত্ব না পাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। এ্যানিকেও মূল দলে রাখার পক্ষে খালেদা জিয়াসহ দলের নীতিনির্ধারকরা। আন্দোলনের মাঠে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নীরবও ছিলেন পুরোপুরি অনুপস্থিত।

নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগসাজশ করে লাপাত্তা হয়েছেন তিনি। ছিলেন এক আওয়ামী লীগ নেতার আশ্রয়ে। বিএনপি নেত্রীও তার প্রতি প্রচণ্ড রকম ক্ষুব্ধ। তাই তারও নেতৃত্ব আসার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। তবে ছাত্রদলের একসময়ের আলোচিত নেতা সানাউল হক নীরুর নাম যুবদলের সভাপতি হিসেবে জোরেসোরে শোনা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন পর তাকে আবার দলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এদিকে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার দৌড়ে আছেন ছাত্রদলের প্রাক্তন সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, আলী আকবর চুন্নুু, মহানগর উত্তরের সভাপতি মামুন হাসান, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর, মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হামিদুর রহমান হামিদ প্রমুখ। তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মীর নেওয়াজ আলী। আপৎকালীন সময় বা বিপদে কর্মীদের পাশে থাকার সুনাম আছে তার। তা ছাড়া, আন্দোলনের মাঠে যে কজন যুবদল নেতা ব্যক্তিক পর্যায় থেকে আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন, নেওয়াজ তার মধ্যে অন্যতম বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির তৃণমূল কর্মীরা।

মহানগর উত্তর-দক্ষিণ : কেন্দ্রীয় কমিটির পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণেও ত্যাগী ও রাজপথে ছিলেন এমন নেতৃত্ব চান দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে এবং সর্বশেষ তিন মাসের আন্দোলনে ঢাকা মহানগর উত্তরে বর্তমান সভাপতি মামুন হাসান ও এস এম জাহাঙ্গীরকে মাঠে দেখা যায়নি। অথচ ঢাকা মহানগরে আন্দোলন জমানোর ক্ষেত্রে মহানগর কমিটিগুলোর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

তবে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, কঠিন প্রতিকূল পরিবেশেও ব্যক্তি চেষ্টা এবং দলের প্রতি ভালোবাসায় মাঠে ছিলেন অনেক নেতা, যারা এবার নেতৃত্বপ্রত্যাশী। নেতা-কর্মীরা চাইছেন, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঢাকা মহানগরেও শক্তিশালী অবস্থানের জন্য ত্যাগী ও দলের জন্য নিবেদিত এসব নেতৃত্ব আনা প্রয়োজন। ব্যর্থতা সত্ত্বেও ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি হিসেবে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীরের নাম শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আবেদীন প্রিন্স, হারুনুর রশিদ হারুন, উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল হোসেন আলোচনায় রয়েছেন। তবে এর মধ্যে প্রিন্সের জন্য বিএনপি নেত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন দলের শীর্ষ দুজন স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য, যারা খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন নেতা হিসেবে পরিচিত।

যুবদল সূত্রে জানা গেছে, যুবদলের ভেতর থেকে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা নির্বাচনের দাবিতে গত বছরের আগস্টে প্রিন্সের নেতৃত্বে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনেক নেতা-কর্মী বিক্ষোভ করেন। তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংগঠনের এই দাবি দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে পৌঁছে দেবেন বলে জানান। এর পর থেকে প্রিন্সের প্রতি যুবদল নেতা-কর্মীদের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া, সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুবদলের অনেক নেতাকে যেখানে খুঁজেই পাওয়া যায়নি, সেখানে প্রিন্স ছিলেন ব্যতিক্রম। বিএনপির আন্দোলনে রাজধানীতে যুবদলের হাতে গোনা যে কয়েকটি মিছিল হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রিন্স।

এদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণে বর্তমান সভাপতি হামিদুর রহমান হামিদ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মজনু। তবে এর মধ্যে মজনু দক্ষিণের সভাপতি পদ পাচ্ছেন, এটি একপ্রকার নিশ্চিত। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদকের দৌড়ে আছেন বর্তমান সহসভাপতি শরীফ হোসেন ও মাসুদ আহমেদ মিলনসহ অনেকে।

যুবদলের নতুন নেতৃত্ব নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান  বলেন, দলের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনেই এবার যোগ্য ও মেধাবীরাই নেতৃত্বে আসবেন। বিগত আন্দোলনে যারা দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিএনপির চেয়ারপারসন দেশে ফিরলেই এ বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই