পৌর নির্বাচন নিয়ে শঙ্কায় বিএনপি

পৌর নির্বাচন নিয়ে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চললেও নির্বাচনে সরকারের প্রভাব বিস্তারের ‘সম্ভাবনা’ আর দলের পুনর্গঠন নিয়ে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব নতুন শঙ্কা সৃষ্টি করেছে বিএনপিতে। যদিও এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে- এ বিষয়টি এক প্রকার নিশ্চিত। তবে নির্বাচনপূর্ব পরিবেশ নিয়ে চিন্তা কিছুতেই কাটছে না দলটির। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্রেফতার আতঙ্ক। দলটির নীতিনির্ধারক এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন আশঙ্কার চিত্র পাওয়া গেছে।

দলের একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপি নেত্রী দেশে না ফিরলেও পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে এরই মধ্যে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা ইঙ্গিত দেওয়া শুরু করেছেন।

পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, ‘আমি আশা করছি, আমাদের নেত্রী (খালেদা জিয়া) খুব শিগগির দেশে ফিরে আসবেন এবং এ বিষয়ে আমরা একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেব। খুব সম্ভব আমরা নির্বাচনে যাব।’

ক্ষমতাসীনদের ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না- এ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘গত চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা অংশ নিয়েছি। এরপর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তাতে সরকারের ব্যবহার দেখেছি। সে ব্যবহার অব্যাহত থাকলে তা আমাদের প্রতিহত করতে হবে।’

ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন সামনে রেখে এ মাসের মধ্যেই ভোটার তালিকা এবং সম্ভাব্য ভোটকে›ন্দ্রগুলো প্রস্তুত করার নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত রয়েছি। নির্বাচন বিধিমালা ও আচরণবিধির সংশোধনী শিগগিরই ভেটিং হয়ে আসবে। সেটি গেজেট আকারে জারির পর ভোটের দিনক্ষণ নিয়ে কমিশন সভায় আলোচনা হবে।’ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট আয়োজনে যত দ্রুত সম্ভব সংশোধিত বিধিমালা জারির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।

এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচনেও প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় মন্ত্রী-সাংসদদের অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখার যে প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন দিয়েছে তা শঙ্কা বাড়িয়েছে দলটিতে। এর ফলে প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করতে পারবে কিনা তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে তাদের। তবে নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে চিন্তার ভাজ পড়েছে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে। বিশেষ করে নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতারের পর নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের।

যেমনটি বলছিলেন নড়াইল জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা পৌর মেয়র জুলফিকার আলী।  তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু পৌর নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোট পেয়ে বিজয়ী হবে। বহির্বিশ্বে বিষয়টি প্রভাব ফেলতে পারে। হয়তো সেই ভাবনা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঠছাড়া করতে তাদের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কেমন হবে বুঝে উঠতে পারছি না।’

জুলফিকার আলী আরো জানান, দল নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। দল অংশ না নিলে তিনি নির্বাচন করবেন না। তবে প্রাথমিকভাবে ভোট ও দোয়া চাচ্ছেন। জেলার দলীয় উচ্চ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক থাকায় কেউ প্রকাশ্যে আসছেন না।

গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক লায়ন আবুল মনসুর মিশন বলেন, ‘পৌর নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে আমরাও আতঙ্কে রয়েছি। তবে সরকারের এই প্রক্রিয়া জনগণ ভালোভাবে নেবে না। ক্ষমতাসীনদের প্রতি জনগণের ঘৃণা আরো বাড়বে। এতে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়বে।’

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ৫ নভেম্বর থেকে ৬টি মহানগর ও ৩২টি জেলায় র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও এপিবিএন- এর সমন্বয়ে যৌথবাহিনী এ অভিযান চালাচ্ছে। তবে রংপুর মহানগরে শুধু পুলিশ বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। ইতোপূর্বে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে এমন ৩২টি জেলাকে এ অভিযানে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ অভিযানে প্রতিদিন সহ¯্রাধিক লোককে যৌথবাহিনী আটক করছে।

জানা গেছে, গত পাঁচ দিনে শুধু ৬টি বিভাগীয় শহরে ১৮১৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রামে ১২ শ’ জন, রাজশাহীতে ২৩৮ জন, সিলেটে ৩২ জন, বরিশালে ৫০, খুলনায় ১৭৮ জন ও রংপুরে ১২১ জন। আটককৃত প্রায় সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ উঠেছে।

পৌর নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতিতে মামলা এবং গ্রেফতার নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। দলীয় দফতর সূত্রে জানা গেছে, তৃণমূল পর্যায়ের প্রায় সব নেতার নামেই রয়েছে একাধিক মামলা। সম্প্রতি নতুন করে গ্রেফতার অভিযানে নেতাকর্মীদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বলতে গেলে ধীরে ধীরে আবার মাঠ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই ও প্রচার চালাতে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়বে দলটি। এছাড়া নির্বাচনের দিন এজেন্ট নিয়োগও বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কারণ, হামলা-মামলা আর গ্রেফতারে বিগত তিন সিটি নির্বাচন নির্দলীয় হলেও বেশিরভাগ কেন্দ্রে তারা এজেন্ট দিতে পারেনি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকা বিএনপির জন্য কঠিন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘পরামর্শক’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের বন্দি রেখে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।’

তিনি বলেন, ‘একদিকে সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। নির্বাচন কমিশন আবার নির্বাচনের কথাও বলছে। নির্বাচন সম্পর্কে এ দলের (বিএনপির) চিন্তা-ভাবনা আমি ভালো করে জানি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, নির্বাচনকে এ দল ভয় পায় না। কিন্তু যতক্ষণ কারাবন্দি নেতারা মুক্তি না পাচ্ছেন, তাদের মুক্ত করা না হচ্ছে, তাদের মুক্ত না করে নির্বাচন হবে একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রার্থী বাছাইয়ে বেশ সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে, দীর্ঘদিন পুনর্গঠনের আওতায় না আসায় তৃণমূলে আগে থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নানামুখী সমস্যা তৈরি হয়েছে। এজন্য দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঠা-া কোন্দল চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থী বাছায়ের ক্ষেত্রে এরই মধ্যে বেশ কিছু এলাকা থেকে বিরোধের তথ্য আসছে বলে বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে।রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই