‘পোশাক কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন’

‘তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সারিয়ে তুলতে বাংলাদেশে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২,৭০০’র বেশি পোশাক শিল্প কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে সেগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, ভবন কাঠামো ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখার জন্য এবং বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ৩২টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত এক হাজারেরও বেশি কারখানা এখন পর্যন্ত পরিদর্শন করা হয়নি। আর যে সব কারখানা নিবন্ধন করা নেই; তাদের অবস্থা এখনও অজানা। বাংলাদেশের এগুলো নিয়ে যারা কাজ করছেন এবং সব স্টেকহোল্ডারদের প্রতি আমাদের অনুরোধ তারা যেন প্রতিটি কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।’

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ‘রানা প্লাজার দ্বিতীয় বার্ষিকী’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। ওই প্রবন্ধে তিনি ওপরের কথাগুলো বলেন। প্রবন্ধটি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে গণমাধ্যমে এক ইলেক্ট্রনিক বার্তায় পাঠানো হয়েছে। পাঠকদের জন্য মার্শা বার্নিকাটের প্রবন্ধটি হুবহু নিচে প্রকাশ করা হল।

‘দু’বছর আগে রানা প্লাজার ভবন ধ্বসের ঘটনা ঘটে, সেই দুর্ঘটনায় চাপা পড়ে মারা যায় শ্রমিকরা, সারা বিশ্বের নজর এসে পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে। মাত্র একদিনেই বাংলাদেশ হারায় এগারোশোর বেশি প্রাণ। আজকে আমরা সেই সব শ্রমিকদের স্মরণ করছি এবং তাদের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে এক হয়ে আমরাও শোক পালন করছি।

আমরা যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, আমরা সেই বাংলাদেশকে দেখি, যার শ্রমিকেরা, কর্মকর্তারা এবং সরকার, বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের পাশাপাশি এক সাথে কাজ করছে যাতে এ রকম ট্র্যাজেডি আর না ঘটে। একসাথে মিলে আমরা উন্নততর এবং অধিকতর উৎপাদনশীল তৈরি পোশাক শিল্পখাত গড়ে তুলছি এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি যে ব্যবসার সফলতা আর শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা হাতে হাত ধরে চলে।’

‘এ ধরনের কুখ্যাত কারখানা দুর্ঘটনা কেবলমাত্র যে বাংলাদেশেই ঘটেছে তা নয়। ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রায়াঙ্গেল শার্ট তৈরির কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান ১৪৬ জন শ্রমিক। রানা প্লাজার শ্রমিকদের মত, ট্রায়াঙ্গাল শার্ট কারখানা দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ছিল অনেক তরুণ-নারী শ্রমিক ছিল যারা প্রথমবারের মত কাজ করে উপার্জন করতে এসেছিল।

রানা প্লাজার ভবন ধসের ঘটনার মত ট্রায়াঙ্গাল শার্ট কারখানার আগুনও প্রতিরোধ করা যেত। ওই কারখানার মালিকেরা সিঁড়ি এবং বাইরে বের হয়ে যাওয়ার দরজাগুলো তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল যার ফলে অনেক শ্রমিকই আগুনে পুড়তে থাকা ভবনটি থেকে বের হয়ে যেতে পারেনি। বরং, জীবন বাঁচানোর জন্য নারী শ্রমিকরা যখন আট, নয় এবং দশ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ছিল আর মৃত্যুবরণ করছিল তখন দর্শকদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’

‘এই দুর্ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে, যার মধ্যে রয়েছে কারখানার নিরাপত্তা মানদণ্ড উন্নয়নের জন্য এবং আন্তর্জাতিক নারী শ্রমিক ইউনিয়নকে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন। ফ্রান্সেস পার্কিন্স-এর নেতৃত্বে জননিরাপত্তা বিষয়ক একটি কমিটি গঠন করা হয়। পার্কিন্স-ই পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শ্রমমন্ত্রী হন। এই কমিটি সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলো শনাক্ত করে এবং নতুন আইনি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে যার মধ্যে ছিল এক কর্মসপ্তাহে সর্বোচ্চ কাজের সময় কমিয়ে আনার জন্য একটি বিল।

কারখানাগুলো সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। নিউইয়র্ক শহরের দমকল বাহিনীর প্রধান জন কেনলন তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছিলেন যে, আগুনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন দু’শোরও বেশি কারখানা চিহ্নিত করেছে তার বিভাগ।’

‘কারখানার নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সারিয়ে তুলতে বাংলাদেশেও একই ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। রানা প্লাজার দূর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২,৭০০’র বেশি পোশাক শিল্প কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে সেগুলোর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ভবন কাঠামো ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখার জন্য এবং বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ৩২টি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ শ্রম ও কর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে এ বিষয়ক সকল তথ্য দেখতে পারবে।

মন্ত্রণালয় থেকে শতাধিক পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়েছে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই কাজ এখনও শেষ হয়নি; জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত এক হাজারেরও বেশি কারখানা এখন পর্যন্ত পরিদর্শন করা হয়নি। আর যেসব কারখানা নিবন্ধন করা নেই; তাদের অবস্থা এখনো অজানা। বাংলাদেশের এগুলো নিয়ে যারা কাজ করছেন এবং সব স্টেকহোল্ডারদের প্রতি আমাদের অনুরোধ তারা যেন প্রতিটি কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।’

‘গুরুত্বপূর্ণ শ্রম অধিকার মানদণ্ড যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের পরিচয় দিতে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ৩০০টির বেশি ইউনিয়ন নিবন্ধত হয়েছে এবং একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে যেখানে গিয়ে ইউনিয়নসমূহ অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারে। এই সকল ইউনিয়নের সদস্যরা যেন সমষ্টিগতভাবে দর-কষাকষি করার তাদের যে আইনগত অধিকার তা প্রয়োগ করতে পারে, বহিষ্কার বা হয়রানি হওয়ার ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারে এবং অবৈধ প্রতিশোধের বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তাদের আইনি অধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সরকারকে উৎসাহিত করছি।

আমরা শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যেন সংঘাতে রূপ না নেয় সেজন্য তা প্রতিরোধে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাকেও স্বাগত জানাই। যে সকল নতুন পরিদর্শক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন এবং শ্রম আইনে উল্লিখিত মজুরি লঙ্ঘন ও অন্যান্য বিষয় সমূহ পর্যবেক্ষণের জন্য তারা কারখানা পরিদর্শন করছেন আমরা তার জন্য অপেক্ষা করছি। এবং শ্রম আইন বাস্তবায়নকারী বিধি জারি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার মালিকপক্ষকে দ্রুতই একটি উন্নততর দিক নির্দেশনা দিবে, শ্রমিকদেরকে তাদের ভূমিকা বুঝতে সাহায্য করবে এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেবে যেন সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারে।’

‘দুর্ঘটনা থেকে পরিবর্তন শুরু হতে পারে এবং তাই হওয়া উচিত। শ্রমিকেরা, বিশেষ করে প্রথমবারের মত কাজ করতে আসা হাজারো তরুণ নারী কর্মীদেরকে অবশ্যই তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরার অধিকার দিতে হবে, তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে ও নিরাপদ পরিস্থিতিতে কাজ করার অধিকার দিতে হবে। পরিদর্শকরা যাতে প্রতিটি কারখানা পরিদর্শনের সুযোগ পায় এবং সেইসব কারখানাগুলোতে যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হবে সেগুলো সংশোধন নিশ্চিত করা ‘বিজিএমইএ’ এবং সরকারের দায়িত্ব।

কারখানার এইসব সংস্কার কাজ উৎপাদনশীলতাও বাড়াসামান্য অবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নে তৈরি পোশাক শিল্প যে অবদান রেখেছে তা মাথায় রেখে এই খাতের ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার পরিকল্পনা এই জাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার, শ্রমিকপক্ষ ও মালিকপক্ষের সাথে অংশীদারিত্বের সাথে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে দেখাতে চায় যে বাংলাদেশ শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নতুন মানদন্ড তৈরিতে কাজ করছে, যা নিশ্চিত করবে যে আর কোনো শ্রমিককে যেন এ রকম দুর্ঘটনার জন্য ভয় পেতে না হয়।’



মন্তব্য চালু নেই