পেশিবহুল দেহের ৮ বছরের হারকিউলিস, এখন কেমন?

সালমান বা হৃত্বিকের সুগঠিত পেশল দেহ কিংবা এইট প্যাকে মুগ্ধ হন অনেকেই। কিন্তু ২০০৪ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সেই সালমান-সুলভ পেশিবহুল দেহ নির্মাণ করে সাড়া ফেলে দিয়েছিল এক শিশু। রিচার্ড স্যানড্র্যাক নামের সেই শিশুর ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ‘ছোট্ট হারকিউলিস’। ২০০৪ সালে তাকে নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি ‘দা ওয়ার্ল্ডস স্ট্রঙ্গেস্ট বয়’ থেকে বিশ্বের মানুষ জানতে পারে তার কথা। প্রায় পাথর কেটে বানানো মূর্তির মতো নিখুঁত পেশিসম্পন্ন তার দেহ দেখে তাক লেগে গিয়েছিল মানুষের। কিন্তু ১২ বছর কেটে যাওয়ার পরে আজ কী করছে সেই শিশু, কেমনই বা দেখতে হয়েছে তাকে? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জেনে নেয়া যাক, সেই ছোট্ট হারকিউলিসের আশ্চর্য জীবনকাহিনি।

১৯৯২ সালে ইউক্রেনে জন্ম হয় রিচার্ডের। বাবা পাভেল ছিলেন মার্শাল আর্ট চ্যাম্পিয়ন, আর মা লেনা অ্যারোবিক্স প্রতিযোগী। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রিচার্ডের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই তাকে নিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন পাভেল-লেনা। নতুন বসতি গড়েন পেনসিলভেনিয়ায়। রিচার্ডের বয়স যখন বছর দু’য়েক তখন থেকেই তাকে ওজন তোলা আর স্ট্রেচিং এক্সারসাইজের ট্রেনিং দেয়া শুরু করেন পাভেল আর লেনা। প্রথম দিকে আর পাঁচটা বাবা-মার মতোই ছেলেকে নীরোগ ও স্বাস্থ্যবান করে তোলার ইচ্ছে ছিল পাভেল-লেনার। কিন্তু দেখা যায়, শরীরচর্চায় অদ্ভুত আগ্রহ রয়েছে রিচার্ডের। সেটা লক্ষ্য করে পাভেল আর লেনা তাদের ছেলেকে পুরোদস্তুর ওয়েট ট্রেনিং দেয়া শুরু করেন। আশ্চর্য ফল ফলে তার। রিচার্ড যখন বছর ছ’য়েক বয়েসে পৌঁছয় তখনই একটানা ৬০০টি ডন বা পুশ আপ, ৩০০টি বৈঠক বা স্কোয়াট এবং ৬০০টি সিট আপ দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে সে। রিচার্ডের বয়স যখন ৮, দেখা যায়, তখন সে বেঞ্চ প্রেস করে ৯৫ কেজি ওজন তুলতে পারছে। অথচ রিচার্ডের নিজের ওজন তখন ৩৫ কেজির মতো। অর্থাৎ নিজের দেহের ওজনের তিন গুণ ওজন বেঞ্চ প্রেস করে তুলতে পারত ৮ বছরের রিচার্ড।

২০০৪ সালে রিচার্ডকে নিয়ে তৈরি হয় তথ্যচিত্র ‘দা ওয়ার্ল্ডস স্ট্রঙ্গেস্ট বয়’। সেই তথ্যচিত্রের সুবাদে শোরগোল পড়ে যায় ‘ছোট্ট হারকিউলিস’কে নিয়ে। বিভিন্ন ম্যাগাজিন কভারে ছাপা হতে থাকে রিচার্ডের পেশিবহুল দেহের ছবি। ২০০৯ সালে তৈরি হলিউড মুভি ‘দা লিটল হারকিউলিস’-এর মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ও করে ফেলে রিচার্ড।

কিন্তু খ্যাতির সোপান বেয়ে রিচার্ড যখন একটু একটু করে উপরে উঠছে, তখনই তার ব্যক্তিগত জীবনে ঘনিয়ে আসে বিপর্যয়। ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা এত অল্প বয়সে রিচার্ডকে এমন বিপুল পেশির অধিকারী হতে দেখে সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, নিশ্চয়ই তার বাবা-মা তার দেহে স্টেরয়েড প্রয়োগ করেছেন। তাছা়ড়া এমন অমা‌নুষিক রকমের শরীরচর্চা কোনো শিশু স্বেচ্ছায় করতে পারে, সেটাও ভাবতে পারেননি ডাক্তাররা। তাদের ধারণা হয় যে, পাভেল-লেনা জোর করে ছেলেকে দিয়ে ব্যয়াম করিয়ে শিশু-অধিকার লঙ্ঘন করছেন। ১০ বছর বয়সের আগে এই ধরনের কঠোর ওয়েট ট্রেনিং-এর ফলে যে রিচার্ডের দেহের গুরুতর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করেন ডাক্তাররা।

ডাক্তার আর দেহবিজ্ঞানীরা যখন রিচার্ডের পেশির রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন, তখনই লেনার উপর শারীরিক অত্যাচার চালানোর অভিযোগে জেলে যেতে হল পাভেলকে। অনেক দিন ধরেই স্ত্রী-এর উপর অত্যাচার চালাতেন পাভেল। রিচার্ড আর লেনা— দু’জনেই মুখ বুজে সহ্য করতেন ব্যাপারটা। কিন্তু একবার যখন মেরে লেনার নাক আর কব্‌জির হাড় ভেঙে দিলেন পাভেল, তখন রুখে দাঁড়ালেন রিচার্ডই। তিনিই খবর দিলেন পুলিশে। যার জেরে গ্রেফতার হলেন পাভেল।

এরপর থেকেই অন্য খাতে বইতে শুরু করে রিচার্ডের জীবন। প্রচারের আলো থেকে ক্রমশ তিনি সরিয়ে নেন নিজেকে। ভাটা পড়তে থাকে শরীরচর্চার উৎসাহেও। যখন ১৫ বছর বয়সে পৌঁছলেন রিচার্ড তখন সারা সপ্তাহে মোট সাড়ে সাত ঘণ্টার মতো ব্যয়াম করেন তিনি। খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি নিষেধই মানেন না। মনের আনন্দে আর পাঁচটা মার্কিন কিশোরের মতোই খেয়ে নেন পিৎজা কিংবা হট ডগের মতো খাবার। স্বভাবতই আস্তে আস্তে শিথিল হতে থাকে তার পেশির গাঁথুনি, পেশিকে পিছনে ঠেলে দেখা দিতে থাকে একটু আধটু মেদ।

আসতে আসতে কোথায় যেন হারিয়ে যান রিচার্ড। বছর পাঁচেক তার খবরই রাখেনি কেউ। তারপর ২০১৫ সালে তাকে খুঁজে বার করে ইনসাইড এডিশন নামের পত্রিকা। তারা একটি ইন্টারভিউ প্রকাশ করে রিচার্ডের। কী করছেন এখন রিচার্ড? কেমন আছেন? উত্তরে তিনি জানান, ভালই আছেন। এখন হলিউডের ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে ওয়াটারওয়ার্ল্ড: আ লাইভ সি ওয়ার স্পেকট্যাকুলার নামের অনুষ্ঠানে স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করেন তিনি। অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে ফুট বিশেক উচ্চতায় স্থাপিত একটি বোর্ড থেকে গায়ে আগুন দিয়ে নীচের জলাশয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন রিচার্ড। ওয়েট ট্রেনিং ছেড়ে দিয়েছেন একেবারে। হালকা কার্ডিওভাসকিউলার এক্সারসাইজ অবশ্য এখনো করেন। ভবিষ্যতে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’র হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন রিচার্ড। কিন্তু ব্যয়াম ছেড়ে দিলেন কেন? রিচার্ড হেসে জানালেন, ‘ছোটবেলাতেই ব্যয়াম করতে করতে বোর হয়ে গিয়েছিলাম।’

কিন্তু সত্যিই কি বাবা-মা জোর করে ব্যয়াম করাতেন রিচার্ডকে? উত্তরে রিচার্ড জানান, কক্ষণও না। হ্যাঁ, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কোনোদিন এতটুকু জোর করেননি বাবা-মা। আসলে বাবা-মাকে শরীরচর্চা করতে দেখতাম। তা থেকেই আগ্রহ তৈরি হয়। তারপর যা করেছি, একেবারে স্বেচ্ছায় করেছি।’-এবেলা



মন্তব্য চালু নেই