পিটিয়ে হত্যাঃ এর শেষ কোথায় ?

পিটিয়ে হত্যা। হ্যাঁ পিটিয়ে মানুষ হত্যার বিষয়টিই এখন টক অব দি কান্ট্রি। হাটে-ঘাটে –মাঠে, চায়ের টেবিলে, অলস মধ্যাহ্নে সর্বত্রই পিটিয়ে মানুষ হত্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সর্বাধিক আলোচিত সিলেটের রাজন হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি পাবনায় হরিজন সম্প্রদায়ের একজনকে, গাইবান্দায় এক কিশোরকে জনসম্মুখে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গণপিটুনীর এই তালিকায় সর্বশেষ আলোচিত সংযোজন হলো রাজধানী ঢাকা শহরের হাজারীবাগে কিশোর রাজাকে পিটিয়ে হত্যা, চাপাই নবাবগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে চারজনকে গণপিটুনী দিয়ে হত্যা, নরসিংদীতে দুইজন, গাজীপুরে একজনকে পিটিয়ে হত্যা। ফেনীতে এবং লক্ষীপুরে দোকান মালিক কর্তৃক শিশু কর্মচারী রমজান ও হামিদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া যশোরে জনৈক সাংবাদিককে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে পিটিয়ে আহত করার মতো ঘটনাও ঘটছে। আলোচিত কিশোর রাজা হত্যার ঘটনাটি হলো ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু তার বাসায় ঢেকে নিয়ে কিশোর রাজাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহত কথিত মোবাইল ও ল্যাপটপ চুরির অপবাদে কিশোর রাজাকে আরজু তার সহযোগী ছাত্র নেতাদের নিয়ে গণ পিটুনী দিয়ে মূমূর্ষ অবস্থায় বাসার পাশে ফেলে রেখে গেলে লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজাকে মৃত ঘোষনা করে। রাজাদের মতো এভাবে প্রকাশ্যে মানুষ মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জনমনে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে, ঘৃনার জন্ম হচেছ। দুঃখজনক হলেও সত্য অমানবিক, নিষ্ঠুর-বর্বরতার এইসব অনকাংখিত ঘটনা জাতিকেও কলংকিত করছে। আধুুনিক সভ্যতার যুগে মানুষ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে অসভ্য অন্ধকার যুগের চরিত্রকে পরিস্ফুটিত করার লজ্জাজনক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছে, পশুর চেয়ে নিকৃষ্টতর জীবের পরিচয় দিচেছ। এ কোন্ সভ্য দেশে আমরা বাস করছি, যেখানে একজন মানুষকে কয়েকজন মানুষ পিটিয়ে হত্যা করছে। অনেক মানুষ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার ডিজিটাল পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে প্রচার মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে প্রলয় নৃত্য করছে। হা সেলুকাস! কি বিচিত্র বাংলাদেশ! এটা ঠিক পিটিয়ে মানুষ হত্যা নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এর প্রচলন ছিল অন্ধকার অসভ্য যুগে। আজ আমরা সভ্য। তাই সভ্য সমাজে পিটিয়ে মানুষ হত্যা অসভ্যতা-বর্বৃরতা, নিষ্ঠুরতার বহিঃপ্রকাশ। ইদানিং বাংলদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন বয়স-পেশার মানূষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচেছ। হত্যার ঘটনা কিছু পত্রিকায় প্রকাশ করছে তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রকাশিত রয়ে যাচেছ। বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যানে এ ধরনের অপকর্মের প্রকাশ ঘটার সুযোগ তৈরী হওয়ায় বিষয়টা জনসম্মুক্ষে আসছে।

সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, গত ৫ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছে ছয় শতের অধিক। সৈয়দ নাজমুল আহসানতার মধ্যে গত মাসে মারা গেছে ৬৬জন। ২০১০ সালে ১২৭ জন, ২০১১ সালে ১৩৪ জন, ২০১২ সালে ১২৬ জন, ২০১৩ সালে ১২৭ জন্য ও ২০১৪ সালে নিহত হয়েছে ১০৫ জন। তথ্য থেকে জানা গেছে বিভাগওয়ারী হিসাবে ঢাকা বিভাগে ৩২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪ জন, খুলনায় ১১ জন। প্রকাশ্যে গণমানুষের সামনে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে এই গণপিটুনীর অমানবিক ঘটনাগুলো কিছুটা খতিয়ে দেখলে দেখা যায় তুচ্ছ কারনেও এসব ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি বহুল আলোচিত-সমালোচিত সিলেটের কিশোর রাজন হত্যার ঘটনাটি ছিল সি এন জি চুরির অপরাধে খুটিতে বেধে পেটাতে পেটাতে হত্যা করার। চুরির অপবাদ দিয়ে কিশোর রাজনকে যারা পিটিয়েছে তারা সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক, বুঝদার , অর্থশালী-প্রভাবশালী ব্যক্তি। হত্যাকারীরা রাজনকে খুঁটিতে বেধে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করেছে, অমানবিকভাবে পানি পান করানো থেকে বঞ্চিত করে, নির্যাতিত অসহায় কিশোরকে নিয়ে তির্যক ভাষায় ব্যঙ্গ করেছে। আঘাতের পর আঘাত করে দানবীয় উল্লাসে মেতে উঠেছে । পাষন্ড এসব নরচিশাচদের নারকীয় কর্মকান্ড অনেকেই দেখেছে, শুনেছে কি›তু প্রতিবাদ করেনি। মানবরুপী হত্যাকারী নরপশুরা ঘটনার চিত্র ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে অপকৃতির মাধ্যমে নিজেদেরকে শক্তিশালী দানব প্রমান করার চেষ্টা করেছে। ফেসবুকের কল্যানে মানুষ রাজন হত্যার নির্মমতা দেখেছে খুনীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। সরকার উদ্যোগী হয়ে রাজনের হত্যাকরীদের গ্রেফতার করেছে। বিচারের আওতায় আনছে। গত ৮ জুন পবিত্র রমজান মাসে এ ঘটনায় সর্বস্তরের মানুষের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কি নিষ্ঠুর মানুষ আমরা নির্মমতার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ঈদের দিন নোয়াখালীতে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে একই পরিবারের তিন ভাইকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে। হত্যাকারীরা পূর্বশত্র“তার জের ধরে জনৈক হারুন-কামাল-বাবলু নামে ৩ ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি দেশবাসীর ঈদের খুশীকে ম্লান করে দেয়। এছাড়া গেলো ১৪ জুলাই কুমিল্লার মুরাদ নগরে ঘটে গেলো আরেকটি গন হত্যার ঘটনা। এদিন মনির নামক জনৈক যুবককে একই গ্রামের ট্রাভেল এজেন্সী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর বাড়ীতে ডাকাতের অপবাদ দিয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মৃত মনির উক্ত মোহাম্মদ আলীর কাছে বিদেশ যাওয়া বাবদ পাওনা টাকা চাইতে গেলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মাইকে ঘোষনা দিয়ে এলাকাবাসীকে উত্তেজিত করে এ ঘটনা ঘটায়। ১২ জুনে ঢাকার খিলক্ষেতে কবুতর চুরির অপরাধে কিশোর নাজিমকে পিটিয়ে হত্যা করে ইসমাইল, নাছির গংরা। গত বছর এ ধরনের পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাগুলোর মধ্যে আলেচিত ছিল সাভারের আমিন বাজারে মাইকে ঘোষনা দিয়ে প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন মেধাবী ছাত্রকে পিটিয়ে গণহত্যার ঘটনাটি।এ ছাড়াও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় পিটিয়ে মাহবুব নামে জনৈক যুবককে হত্যা এবং মোহাম্মাদ আমিনকে আহত করা হয়। ১১ জুলাই ঢাকার অদূরে সিদ্ধিরগঞ্জে মোবাইল চুরির অপবাদে নাঈমকে গণপিটুনী দিয়ে হত্যা, ৮ জুলাই গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অজ্ঞাত যুবককে চুরির অপবাদে হত্যা, ২ জুলাই রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে চোর সন্দেহে সাব্বিরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৮ জুন মাগুরায় গণপিটুনীতে সাদ্দাম নামে এক ব্যক্তি এবং ২৪ জুন ফরিদপুরের কৈজুরীতে নিহত হয় বাচ্চু হাওলাদাার, রোজউল শেখ ও মোশাররফ শেখ। ১৭ জুন রাজধানীর ওয়ারীতে গনপিটুনতে রাসেল ২৪ মে যশোর পলিটেকনিক ছাত্র ইসমাইল ও তার বন্ধু আল আমীন হত্যা, ২২ মে রাজধানীতে উত্তরায় রেললাইন বস্তিতে চোর সন্দেহে পারভীন আক্তার । ২১ মে নেত্রকোনায় মোবাইল চুরিকে কেন্দ্র করে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গণপিটুনীর শিকার হয়ে মারা যায়। ১৮ মে কেরানীগঞ্চের হযরতপুরের রসুলপুরে ডাকাত সন্দেহে সোহাগ, ১৭ মে উত্তরায় চোর সন্দেহে অজ্ঞাত যুবক। ২২ ফেব্রƒƒয়ারী রাজধানীর মীরপুরে জুয়েল সুমন ও রবিন নামে যুবক গণপিটুনীতে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও তাদের শরীরে ৫৪ টি গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়। ১৬ মে চট্টগ্রামে টাইগার পাস এলাকায় মন্দিরের কাছে গণপিটুনীতে নিহত হয় সাদ্দাম নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী। ১৯ ফেব্র“য়ারীতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে বোমাবাজ সন্দেহে নিহত হয় জনৈক যুবক। পাবনায় হরিজন সম্প্রদায়ের একজনকে চুরির অপরাধে, খুলনায় রাজীবকে মলদ্বারে কম্প্রেসার দিয়ে এবং পিটিয়ে অভিনব কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। বরগুনায় শিশু রবিউলকে গাছের সাথে বেধে পিটিয়ে হত্যার পর সর্বশেষ সংযোজন রাজধানীতে ঢাকা টু সিলেটগামী শ্যামলী পরিবহনের গাড়ী চালক দেবু সাহাকে যাত্রীরা পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিহত গাড়ী চালকের অপরাধ ছিল সে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকায় গাড়ী থামিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী উঠাচিছল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যাত্রীরা ড্রাইভিং সিটে বসা চালককে লাঠি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। একটি পরিবহনে যাত্রী একজন,দুইজন নয় অনেকজন ছিল। সেখানে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সী যাত্রী ছিলেন। কিন্তু কারো কোনো শুভ বুদ্ধির চেতনা বোধ ছিল না। বিবেক বর্জিত সবাই নিজ স্বার্থে হয়তোবা দ্রুত যাতায়তের লক্ষ্যে বাস চালককে পিটিয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করেনি প্রতিহতও করেনি। পিটিয়ে হত্যার সব ঘটনাগুলোর অধিকাংশই তুচছ কারনে ঘটছে। যে কোনো ধরনের ধরনের অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য আইন-বিচার রয়েছে। সেদিকে না গিয়ে অন্যায়কারীকে শায়েস্তা করার নামে পিটিয়ে হত্যা করা হচেছ। এটাঁ বড় নির্মমতা-অমানবিকতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া হচেছ। নির্মম-নিষ্ঠুর-নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হচেছ। ইদানিং পিটিয়ে হত্যার ঘটনা বাড়ছেই। গত কয়েক দশকে দেখা যাচেছ বাংলাদেশে অপকৃতি একবার শুরু হলে এর রেশ চলে বেশ কিছুদিন।হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং এরকমি ছিল। পিটিয়ে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রেও তেমনটি মনে হচেছ। দেশের সর্বত্র এর অবাধ বিচরন চলছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার খবরেও অপকর্ম থামছে না। বিবেক বর্জিত অপরাধীরা অবাধে অপরাধের মহোৎসব পালনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পিটিয়ে হত্যার মহোৎসবে কয়েকটি বিষয় স্পস্ট হয়ে উঠছে। নীতি-নৈতিকতার অধঃপতন, বিচারহীনতা,স্বার্থবাদী চিন্তা-চেতনার প্রবনতা বৃদ্ধি,স্বৈরাচারী-সন্ত্রাসী মনোভাবের দাম্ভিকতা, দেশপ্রেমের অভাব, শিল্প-সংস্কৃতির চেতনার দৈন্যতা ইত্যাদি কারনে আলোচিত-সমালোচিত পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। আগে আমাদের সামাজিক বন্ধন ব্যবস্থা ভালো ছিলো, সমাজের ভুল ক্রটিগুলো শোধরানোর দায়িত্ব সমাজ নিতো। সামাজিক বিচার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রচলন ছিলা শ্রদ্ধাবোধের অকৃত্রিমতা ছিল। মানবিকতা-মূল্যোবোধের স্বতঃস্ফ’র্ততা ছিল। বিচারহীনতার জন্য জনমনে আতংক ছিলো না। এ ধরনের অনেক ইতিবাচক কারনগুলোর অনুপস্থিতিই পিটিয়ে হত্যার মতো অপকর্মের পরিধি বাড়াচেছ বললেও অতিরঞ্জিত বলা হবে না। কাজেই পিটিয়ে হত্যার মতো ন্যাক্কার জনক ঘটনা ঘটার কারন চিহ্নিত করা খুব একটা জটিল বিষয় নয়। এটা ঠিক যে, পিটিয়ে হত্যার ঘটনা এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতিদিন এর সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া দেশব্যাপী বি¯তৃত হয়ে পড়ছে এই পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। বিচারহীনতার কারনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পিটিয়ে হত্যার লাগামহীন ঘটনাগুলো নিয়ে স্বাভাবিক কারনেই আতংক-ভয়- দুশ্চিন্তা বাড়ছে। নির্লজ্জ এই অপকর্মের টুটি চেপে ধরে দ্রুত পিটিয়ে হত্যার নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ দেয়া জরুরী বলে মনে করছে হতভাগা দেশবাসী।পিটিয়ে হত্যা নিয়ে আতংকিত জনমনে একটি প্রশ্নই গুরপাক খাচেছ- আলোচিত পিটিয়ে হত্যার শেষ পরিণতি কি কিংবা এর শেষ কোথায় ?

লেখকঃ কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই