পাবনার ঐতিহ্যবাহী ইছামতি নদীটি দখল আর দূষণে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে

পাবনা শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের স্রোতস্বীনি ঐতিহ্যবাহী ইছামতি নদীটি দখল আর দূষণে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যে নদীতে পদ্মাবোটে চড়ে অসংখ্যবার পাবনায় এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই ইছামতি নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

অব্যাহত দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে জেলার কয়েক লাখ মানুষ। নদীতে প্রবাহ না থাকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে জেলার পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর। এতে করে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পাবনা শহর। মরা খালে পরিণত হওয়া নদীটির দখল বা দূষণ রোধে নেই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ের অভাব ও পর্যাপ্ত বাজেট সংকটের কারণে নদী উদ্ধারের পদক্ষেপ মুখ থুবড়ে পড়ছে বারবার।

১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা দিবসে পাবনাবাসীর দাবি, মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হোক ইছামতি নদীর।
জানা যায়, বাংলার নবাব ইসলাম খাঁ ১৬০৮-১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে সৈন্য পরিচালনার সুবিধার্থে পদ্মা ও যমুনা নদীর সংযোগ স্থাপনার্থে পাবনা শহরে একটি খাল কাটেন, যার নাম দেন ইছামতি। এক সময়ের খরস্রোতা পাবনার ইছামতি নদী দিয়ে চলতো নৌকা-জাহাজ। এই নদী দিয়েই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নৌকায় চড়ে শাহজাদপুর আসা-যাওয়া করতেন।

কিন্তু সেই নদীর বর্তমান অবস্থা তার উল্টো। স্রোতস্বীতি প্রবাহমান ইছামতি নদী তার যৌবন হারিয়ে আজ মৃত প্রায়। শহরের বুকের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি নদীকে এখন সবাই আক্ষেপ করে বলেন, ময়লা আবর্জনার ভাগাড় বা পৌরসভার ড্রেন। অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়, ৩০ বছর আগেও প্রবাহমান এই নদী ছিল পাবনাবাসীর জন্য আশির্বাদ।

পৌরবাসীর কাছে এ নদী গত তিন দশক যাবৎ সম্পদ হয়ে উঠতে পারছে না। নদীর দুই পাড় দখল করে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মহোৎসব চলছে। শহরের সকল বাসা বাড়ি, হাটেল রেস্তোরার আবর্জনা, ক্লিনিকের যাবতীয় বর্জ্য পদার্থ ও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। স্লুইস গেট বানিয়ে পানি আটকে পরিকল্পিতভাবে নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। অব্যাহত দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে জেলা শহর ও এর আশপাশের কয়েক লাখ মানুষ। বাড়ছে নানা রোগ।‘এভাবে স্থাপনা নির্মানের মাধ্যমে ইছামতি নদীর দুপাড় দখল হচ্ছে ’
‘এভাবে স্থাপনা নির্মানের মাধ্যমে ইছামতি নদীর দুপাড় দখল হচ্ছে ’

তথ্য মতে, পাবনা থেকে বেড়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর অর্ধেক এখন নর্দমা। এর মধ্যে পৌর এলাকার মধ্যে রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার। নদী ভরাটের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বর্তমানে ময়লা-আবর্জনার দূর্গন্ধ ও মশা-মাছির আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। উৎস মুখের কাছে (বাংলা বাজারে স্লুইস গেট) প্রায় ভরাট করে ফেলায় এ নদী হয়ে পড়েছে প্রাণহীন।

নদীটি পাবনার উত্তর প্রান্ত দিয়ে পূর্বে আতইকুলার পাশ দিয়ে নদীরূপে এগিয়ে গেছে। সাঁথিয়া সদরের পাশ দিয়ে বেড়া সদরের বৃ-শালিখা এলাকার হুরাসাগর নদীতে গিয়ে মিশে যমুনায় পড়েছে। ১৯৭৮ সালে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করার সময় ইছামতির সঙ্গে বড়াল নদীর সংযোগ মুখে নির্মাণ করা হয় স্লুইস গেট। এ ছাড়া বেড়ার কাছেও ইছামতির প্রান্তখাত বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেড়া থেকে আতাইকুলা পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ইছামতি পূনঃখনন করা হয়। বেড়া পাম্প হাউজের সাহায্যে পানি পাম্প করে খননকৃত অংশের নদীর পেট ভরে পানি রাখা হচ্ছে সেচ কাজের জন্য। কিন্তু অবশিষ্ট ২০ কিলোমিটার নদী ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শহরের নর্দমাগুলোর চেয়ে ইছামতির তলদেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। দখল হয়ে গেছে নদীর কিনারা।

১৯২২ সালের ডিএস মৌজা ও ম্যাপ অনুযায়ী ২০০৫ সালে সর্বশেষ জরিপ কাজ চালায় জেলা প্রশাসন। সেই জরিপের তথ্য হিসেবে, নদীর উৎসমুখ সদরের চর শিবরামপুর থেকে পাবনা পৌর এলাকার শালগাড়িয়া শ্মশানঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটারব্যাপী ৭টি মৌজায় নদীর ৫ হাজার বর্গফুট এলাকা বেদখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ১২০ থেকে ২০০ ফুট প্রস্থের ইছামতি নদী এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ ফুটে। নদীর পাড় দখল করে বসবাস করা অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা ২৮৪ জন

২০০৫ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ৪০ লাখ টাকা ব্যায়ে নদীর কিছু অংশ খনন ও পরিষ্কারের কাজ করে। এ ছাড়া ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নদী খননের জন্য প্রায় ২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বর্জ্য অপসারণ ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হলেও তা আর শেষ করা হয়নি।

পাবনা সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক আব্দুল খালেক মিঠু বলেন, ‘নদীর দুই পাড় যেভাবে দখল করে প্রভাশালীরা বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছেন, তাতে নদী উদ্ধার সহজ কাজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ যখন যে দল ক্ষমতায় আসে দখলদাররা তখন সেই দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। কঠোর হাতে নদী উদ্ধার করতে পারলে আমরা সবদিক দিয়ে উপকৃত হবো।’

বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও প্রবীণ সাংবাদিক রনেশ মৈত্র বলেন, ‘আমার মনে হয়, সরকার নদী উদ্ধারে নিষ্পৃহ। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে তারা এটাকে আগ্রহের সঙ্গে দেখেনি। আবার সরকারি দলের নেতারাও এগিয়ে আসেনি। তিনি মনে করেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইছামতি নদী উদ্ধারের আন্দোলন জোরদার করা গেলে নিশ্চয়ই একটা ফল বয়ে আনতে পারে।’

নদী গবেষক নরেশ মধু বলেন, ‘কোনো কিছুর সঠিক পরিকল্পনা মানেই হলো কাজটির প্রায় ৬০ ভাগ কাজ শেষ করা। ইছামতি নদীকে বাঁচাতে এবং জেলার পরিবেশ প্রকৃতিকে বাঁচাতে গেলে সমন্বিত সঠিক পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দরকার। তা না হলে ইছামতি নদী উদ্ধার স্বপ্নই থেকে যাবে।’ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ নূরুন্নবী বলেন, ‘এই নদী অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী। স্বপ্ন দেখি আবারো প্রবাহমান হবে ইছামতি। আর নদীর দুইধারে থাকবে গাছের সারি। বিনোদনের একটা জায়গা হয়ে উঠবে ইছামতি। যৌবন ফিরে পেয়ে সকলের জন্য ভূমিকা রাখবে এই নদী। ইছামতি নদী খনন করে পদ্মার সাথে সংযোগ করলে জমে উঠবে ব্যবসা বানিজ্য। সচল হবে তীরবর্তী ঘাটগুলো। যাতায়াতে নতুন ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ হবে পাবনা।’

এ বিষয়ে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোশারোফ হোসেন বলেন, ‘ইছামতি নদী উদ্ধারের বিষয়ে অনেকবারই বিভিন্ন ফোরামে বলা হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের অভাবে কাজ করা হয়নি। এবার আমাদের জেলায় ভূমিমন্ত্রী আছেন, আরো চার জন সংসদ সদস্য আছেন।’ সবার সঙ্গে কথা বলে সমন্বিতভাবে নদীকে উদ্ধারে কাজ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

পাবনার জেলা প্রশাসক কাজী আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘নদীটি ভরাট হওয়ায় এবং বিভিন্ন অবৈধ দখলদারদের জন্য এখন আর পূর্বের অবস্থায় নেই। এ কারণে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি আমরা। সর্বশেষ পরিবশে অধিদপ্তর থেকে অবৈধ দখলদারদের অপসারণ ও দূষণ রোধে একটি নির্দেশনা এসেছে। আমরা সেই নির্দেশনা অনুযায়ী পৌর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের নোটিশ পাঠিয়েছি। কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার জানান, ‘২০১১ সালে ইছামতি নদী পুণঃখনন ও পাবনা শহর এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রায় ১০ কোটি টাকার এই প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ২০০৪ সালের ৮ জানুয়ারি। কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন হয়নি।’ কেন হয়নি তা অবশ্য জানাতে পারেননি তিনি। তিনি মনে করেন, ‘কোনো দপ্তরের একার পক্ষে নদী উদ্ধার সম্ভব নয়, দরকার সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সম্মিলিত প্রয়াস।’

পাবনা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী তাবিবুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পেয়ে গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ইছামতি নদী খননে সামান্য কিছু কাজ করেছিল পাবনা পৌরসভা। এই সামান্য বরাদ্দে ইছামতি নদী খনন করে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার বৃহৎ পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে দরকার পর্যাপ্ত অর্থায়ন।’

তিনি আরো বলেন, ‘তারপরও পাবনা পৌরসভা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ আরো যারা সংশ্লিষ্ট আছেন, তাদের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।’



মন্তব্য চালু নেই