পাচারকারীদের এলাকায় ফেরার আতঙ্কে ভুক্তভোগীরা

আত্মগোপন থেকে মানবপাচার চক্রের সদস্যরা আবারও এলাকায় ফিরে আসার আশঙ্কায় ভুগছেন ভুক্তভোগীরা। এ কারণে মানবপাচারের শিকার অনেক পরিবার এখনও পুলিশের কাছে অভিযোগ দিচ্ছে না।

মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও বেসরকারি সংগঠন হেল্প কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, ‘এর আগেও বিভিন্ন সময় প্রশাসন মানবপাচারকারীদের ধরতে বিশেষ অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রশাসনের তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলে মানবপাচারকারীরা পুনরায় পুরনো পেশায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।’

তিনি বলেন, বর্তমানে প্রশাসনের যে অভিযান চলছে তা একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। অপরাধীরা এ সুযোগেরই অপেক্ষায় আছে। আর অপরাধীরা ফের এলাকায় ফিরে আসার ভয় সবার মধ্যেই কাজ করছে। এ কারণে কক্সবাজারের অনেক মানবপাচারের শিকার ভুক্তভোগী পরিবার আছেন, যারা এখনও পুলিশের কাছে তাদের অভিযোগ নিয়ে যাচ্ছেন না।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, উখিয়ার তিলছড়ি হাফিজিয়া মাদরাসা থেকে গত দুই মাস আগে ৩ হাফেজ নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের একজন হাফেজ সাইফুল। তার বড় ভাই আব্দুর রশীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, দালালদের ভয়ে থানায় এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগও করেনি। কেউ কেউ নাকি তাদের বলেছে, থানায় জানিয়ে কী লাভ? ওদের (দালাল) সাথে তো থানা পুলিশের ভাল সম্পর্ক। ফের ওরা (দালাল) ফিরে আসলে সমস্যা হবে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে আটকে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতনের পর নির্বিচারে হত্যা করে দালালচক্র। সাম্প্রতিক সময়ে ওই দু’টি দেশে ৪০টির মতো গণকবর আবিষ্কার হয় এবং এ দু’টি দেশসহ ইন্দোনেশিয়ার উপকূল এলাকা থেকে শত শত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রে খাবার ও পানীয় জলের অভাবেও নির্মমভাবে বহু মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। যা একের পর এক আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশের পর বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানবপাচার বন্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। এ প্রেক্ষাপটেই মানবপাচারের প্রধান রুট কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ সংশ্লিষ্ট পাচারপ্রবণ এলাকায় অভিযান শুরু করে র‌্যাব, পুলিশ।

এদিকে প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর থেকেই একে একে আত্মগোপনে চলে যান কক্সবাজারের চিহ্নিত মানবপাচার চক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে জেলার প্রধান মানবপাচার জোন হিসেবে পরিচিত টেকনাফ ও উখিয়ায় ৫ জন মানবপাচারকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় এলাকা ছাড়া হন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত পাচারকারীরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে জেলায় ১৭৬ জন তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারী রয়েছে। তবে, কক্সবাজার পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির তথ্য মতে, মানবপাচারকারীর সংখ্যা তিন শতাধিক। গত এক মাস ধরে চলা অভিযানে ৫ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে ৫০ জনের বেশী।

কক্সবাজার গোয়েন্দো পুলিশের (ডিবি) ওসি দেওয়ান আবুল হোসেন বলেন, ‘মে মাসে জেলায় ৫০ জনের মতো মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ফলে গ্রেফতার আতঙ্কে মানবপাচারকারীরা আত্মগোপনে চলে গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।’

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনের বিশেষ অভিযান ও ক্রসফায়ারের ভয়ে মানবপাচার চক্রের গডফাদারদের বেশীরভাগই কক্সবাজার জেলা ছেড়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। আর সাধারণ মানবপাচারকারীরা কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়-টিলা ও গহীন এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকেই আবার তবলীগ জামাতেও গেছে বলে জানা গেছে।

তবে, মূল পাচারকারীরা দূরে আত্মগোপনে থাকলেও তাদের অনেক অনুসারী নিরাপদ দূরত্বে এলাকায় থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। স্থানীয়দের আশঙ্কা অপরাধীরা সুযোগ বুঝে আবার এলাকায় ফিরে এসে পুনরায় মানবপাচারের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত হওয়ার সুযোগ খুঁজছে।

মানবপাচার নিয়ে কাজ করা আরেক বেসরকারি সংগঠন পালস্ কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের সাথে মানবপাচারের গডফাদারদের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে রহস্যজনক কারণে তাদের আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। থাইল্যান্ডে মানবপাচারের দায়ে পুলিশ গ্রেফতার হয়েছে। অথচ এ দেশে তারা ছাড়া পেয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, `মানবপাচারের গডফাদারদের ধরতে গেলেই তাদের হস্তক্ষেপ প্রশাসনের ওপর চলে আসে। ফলে গডফাদাররা আজও অধরা, কেবল ছোট ছোট দালালরাই ধরা পড়ছে।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, `সম্প্রতি প্রশাসনের অভিযানে বেশ কিছু মানবপাচারকারী গ্রেফতার হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে মারাও গেছে। ফলে মানবপাচারকারীরা এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন। পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রতিদিন জেলার কোনো না কোনো স্থানে মানবপাচারকারী আটক হচ্ছে।’

প্রশাসনের অভিযান বন্ধ হলেই অপরাধীরা পুনরায় এলাকায় ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে— এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো মানবপাচারকারী পুনরায় মানবপাচারে জড়িত হতে পারবে না। কারণ পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেকুজ্জামান বলেন, ‘মানবপাচাররোধে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির টহল জোরদার রয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায়ও বিজিবির বিশেষ টহল রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মানবপাচার প্রতিরোধে বিজিবির নজরদারী এখন যেমন রয়েছে, সামনেও থাকবে। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা দরকার।’

কোস্টগার্ডের সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার লে. ডিক্সন চৌধুরী বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের উপকূলীয় এলাকা ও বঙ্গোপসাগরের নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে কোস্টগার্ডের বিশেষ টহল ও নজরদারী রয়েছে। আশা করছি সবাই সহযোগিতা করলে ভবিষ্যতে মানবপাচাররোধ করা সম্ভব হবে।’ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই