পরিবার বাইরে পাঠাতে শুরু করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা

নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ঢাকায় থাকা বিদেশি কূটনীতিক, কর্মকর্তা ও স্টাফরা তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পশ্চিমা কূটনীতিক ও স্টাফদের অনেকে এরই মধ্যে পরিবার সরিয়ে নিয়েছেন। জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্তত ৪ জন কর্মকর্তা ঢাকায় আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবহিতও করেছেন। দায়িত্বশীল একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে এই তথ্য মিলেছে।

সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের ঢাকাস্থ মিশন তাদের কূটনীতিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবারের সদস্যদের জন্য ‘ভলান্টারি রিপেট্রিয়েশন বা ইচ্ছা করলে চলে যাওয়া’র সুযোগ অবারিত করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় নিরাপত্তা চেয়েছে ইইউ।

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় গত ১লা জুলাই জঙ্গি হামলা পরবর্তী নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধানসহ ইইউ জোটের মিশনগুলোর জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে গেছেন।

ইইউ মিশন সূত্র জানিয়েছে, গুলশানে গত বছরের শেষ দিকে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা খুনের পর থেকেই ঢাকা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে ব্রাসেলস। ঢাকায় থাকা কূটনীতিক ও স্টাফদের সেই সময় থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। সদ্য ঢাকা সফরকারী ব্রাসেলস’র প্রতিনিধি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেই সতর্কতা আরো জোরদারের পরামর্শ দিয়ে গেছেন।

কূটনৈতিক জোনে জঙ্গি হামলার পর থেকে গত এক মাসে কূটনীতিক ও স্টাফ মিলে অন্তত অর্ধশত পরিবার ঢাকা ছেড়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া অবশ্য গত বছরের শেষ দিকে তাদের ঢাকাস্থ হাই কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘চাইলে চলে যাওয়া’র সুযোগ দেয়। দেশটির বেশিরভাগ কূটনীতিক ও কর্মকর্তার পরিবার সুযোগটি নিয়েছে, তারা তখনই ঢাকা ছেড়েছেন।

সেই সময়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় ক্যানবেরার পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘নিরাপত্তা সতর্কতা’ হালনাগাদ করা হয়। বিদেশিদের ওপর হামলার আশঙ্কায় অস্ট্রেলিয়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়। গুলশান ও শোলাকিয়ায় পরপর দুটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও স্টাফরা ‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ অবস্থায় রয়েছেন।

অনেকে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে দেশে গেছেন। তারা বাইরে থাকলেও ঢাকা পরিস্থিতির ওপর প্রতিনিয়ত নজর রাখছেন। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে কূটনৈতিক পল্লী থেকে যে খবর বেরিয়েছে তাহলো- নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকের ছুটির মেয়াদ বাড়তে পারে।

এর মধ্যে জার্মানির এক কূটনীতিক এবং দেশটির দূতাবাসের একজন উন্নয়ন কর্মকর্তা আর ঢাকায় না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা তাদের ঊর্ধ্বতন মহলে সেটি জানিয়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. থমাস প্রিঞ্জ সমপ্রতি এক সাক্ষাৎকারে এটি নিশ্চিত করেন। বলেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলাপরবর্তী পরিস্থিতি আগের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এ ঘটনার পর অনেকেই বাংলাদেশ ছাড়ছেন। বিশেষ করে যাদের শিশু-সন্তান রয়েছে। তবে ঠিক কতজন একেবারে ছেড়ে গেছেন তা এখনই বলা যাবে না। গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হলেই পুরো চিত্র পাওয়া যাবে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত ড. প্রিঞ্জ বলেন, আমার দুজন সহকর্মী আর ফিরবেন না বলে জানিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জার্মান দূতাবাস তাদের ইন্টার্নি প্রোগ্রাম, লিগ্যাল এইড ট্রেনিংয়ের মতো কর্মসূচিও বাতিল করেছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।

তিনি অবশ্য ওই ঘটনার পর সরকারের নিরাপত্তা উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। বলেন, নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে নিরাপত্তা অনেক বেড়েছে। কিন্তু এটাও সত্য গুলশানে অনেক লোকের বাস। এখানে বাইরে থেকে অনেকে আসেন। এ রকম একটি এলাকাকে শতভাগ নিরাপদ করা হয়তো সম্ভব নয়। জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় গোয়েন্দা তৎপরতা আরো জোরদারের পরামর্শ দেন রাষ্ট্রদূত।

এদিকে দূতাবাসের নাম, পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটের প্রভাবশালী এক সদস্য রাষ্ট্রের দুজন শিক্ষানবিস কর্মকর্তা ঢাকা ছেড়ে গেছেন। তারা আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলতি বছরের পুরো সময় ওই কর্মকর্তাদের ঢাকায় কাজ করার কথা ছিল।

ওদিকে গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সোফি অ্যাবোর্ট জানিয়েছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা বিবেচনায় ঢাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনায় আগ্রহী তার দেশ। ঢাকায় জঙ্গি হামলার পর থেকে তারা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, দূতাবাসে নিযুক্ত কূটনীতিক, কর্মকর্তা ও স্টাফদের এখানে থাকার বিষয়টি সময় এবং পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দিয়েছি।

রাষ্ট্রদূতের মতে, ঢাকায় সুনির্দিষ্ট কোনো হামলার হুমকি না থাকলেও বাংলাদেশে পুলিশ কিভাবে কাজ করছে, মানুষের মনে আস্থা ফিরছে কি-না? কোনো হামলার হুমকি এলে তা মোকাবিলার কৌশল কী হবে? এসবের ওপর তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে। গোয়েন্দা তথ্য সবচেয়ে জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারা কখন এ ধরনের হামলা করতে পারে তাদের গতিবিধি জানাতে হবে সবার আগে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত। ওদিকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডসহ অনেক দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্ধারিত ছুটি শেষে তাদের কূটনীতিক ও স্টাফরা ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। তাদের কেউ কেউ গুলশান হামলার আগেই ছুটিতে গিয়েছিলেন। ঢাকাস্থ বৃটিশ হাই কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ছুটিতে থাকা মিশনের দু’জন কর্মকর্তা চলতি সপ্তাহে কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। বাকি কূটনীতিক ও স্টাফরা চলতি মাসের প্রথমার্ধেই ফিরবেন।

পরিবার সরিয়ে দেয়া ‘সাময়িক’ পদেক্ষপ- পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী: বিদেশি কূটনীতিক ও স্টাফদের পরিবার সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি ‘সাময়িক’ বলে মনে করেন সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি। গতকাল নিজ দপ্তরে সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, গুলশানে হামলার পর অনেকে হয়তো আতঙ্কিত হয়ে আপাতত তাদের পরিবারকে দেশে পাঠিয়েছেন।

পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্রেডিট দিতে হবে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর যেভাবে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপে সেটি অনেকটাই কেটে গেছে।

কূটনৈতিক জোনসহ সারা দেশে বিদেশিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিবার সরিয়ে নেয়ার যে সুযোগ দেয়া হয় সেটি সাধারণত ৬ মাস মেয়াদের হয়। এটাই স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস। গুলশানের ঘটনা যেভাবে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে নাড়া দিয়েছে, নিরাপত্তায় সর্বমহলে যে সাড়া পড়েছে এটি বিশ্বের অন্য কোনো দেশে ঘটেছে বলে আমি দেখিনি।

আগামী দিনে এমন ঘটনা আর না ঘটলে বিদেশিদের পরিবারগুলো অবশ্যই ঢাকা ফেরত আসবে বলে আশা করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। অস্ট্রেলিয়ান পরিবারগুলোকে গত ডিসেম্বরেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কোনো কূটনীতিক বা স্টাফ পর্যায়ে কেউ এখনও যাওয়ার কথা বলেননি বরং তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগে স্বস্তিবোধ করছেন বলে জানিয়েছেন।

গুলশানের ঘটনায় ৭ জাপানির লাশ হস্তান্তরসহ অন্যান্য কার্যক্রম দেখভালে দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ঢাকা সফরের উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, আমি অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা তার সঙ্গে ছিলাম। সে সময়ে জাপান থেকে আসা নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তাদের অনেকে ইংরেজি জানেন। তারা আমাদের ‘থ্যাংকস’ বলেছেন।

এছাড়া আসেমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাপান, ইতালিসহ এশিয়া-ইউরোপের শীর্ষ নেতৃত্বের কথা হয়েছে। তারা সহযোগিতার কথা বলেছেন। কেউই উদ্বেগের কথা বলেননি। বিদেশিদের নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেবো। গুলশানে এখন ডাবল চেক হয়।

তারা যে ধরনের নিরাপত্তা চাইবেন সরকার তা দেয়ার চেষ্টা করবে। এত কিছুর পরও জার্মানির দুই কর্মকর্তার না ফেরার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি শুনেছি, খোঁজ নিচ্ছি। পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তাও এ বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেন।-এমজমিন



মন্তব্য চালু নেই