দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন

পররাষ্ট্রনীতির ধারা পাল্টে দিলেন মোদি

ঢাকার সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৌশলগত দিক থেকে বঙ্গোপসাগরের প্রতি যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাকে যথাযথই বলতে হয়। এটা ছিল দীর্ঘদিনের দাবি। ভারতের পূর্বাঞ্চলের এই জলরাশি এ পর্যায়ে চীনের গুরুত্ব পেলেও তাতে ভারতের আগ্রহ সীমিত এবং খণ্ডিত বলে প্রতীয়মান হয়। বঙ্গোপসাগর চীনের কাছে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক উভয় কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। চীন তিব্বত ও ইউনানসহ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়নের চেষ্টা করছে, ফলে বঙ্গোপসাগরে ঢোকা তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের সমুদ্রপথে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের পথ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। আবার মাঝেমধ্যে সরু মালাক্কা প্রণালি দিয়েও এ বাণিজ্য হয়, যে প্রণালি ভারত মহাসাগরকে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথে নানা হুমকি আছে— এই ভয়ে চীন তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের পর্যন্ত একটি বিকল্প সড়কপথ নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। চীন আবার বঙ্গোপসাগরে তার উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে, যাতে ভারত মহাসাগরে তার ক্রমবর্ধমান স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

ভারতের অর্থনৈতিক কার্যক্রম এত দিন ভেতরমুখী ছিল। আর উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের স্থলসীমান্ত নিয়েও সে বেশ নাজেহাল হয়েছে। ফলে এত দিন তার পক্ষে সমুদ্র সীমানা নিয়ে মাথা ঘামানো সম্ভব হয়নি। ভারত ১৯৯০-এর দশকে লুক ইস্ট নীতি গ্রহণ করলে দিল্লি বঙ্গোপসাগরের ব্যাপারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। ওদিকে ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে বঙ্গোপসাগরে দিল্লির কৌশলগত স্বার্থ আরও সংহত হয়। নতুন ভূরাজনৈতিক প্রবণতা নিয়ে অনেক হাত মোচড়ামুচড়ি হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তেমন ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। মোদি সেটা বদলানো শুরু করেছেন।

নীল অর্থনীতি: মোদি ঢাকায় গিয়ে কিছু কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন, যেগুলোর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর উদ্ভূত ভারতের অর্থনৈতিক সুবিধা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এর একটি হচ্ছে, দুটি দেশের মধ্যে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল। এতে দুই দেশের মধ্যকার পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ দুটোই কমবে। বর্তমানে দূরবর্তী তৃতীয় দেশের বন্দরের মাধ্যমে এই পণ্য পরিবহন হয়। এই চুক্তির ফলে বন্দরে পণ্য এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে স্থানান্তরের খরচ কমবে। দুই দেশের সড়ক যোগাযোগ এমনিতেই ভারাক্রান্ত, এটা হয়ে গেলে তার ওপরও চাপ কমবে। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল যদি বহুদিনের বকেয়া বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয়, ঢাকা ও দিল্লি সমুদ্র সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সমুদ্রসীমা নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ গত বছর মিটে যাওয়ায় মোদি ও হাসিনা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন, দেশ দুটি ‘সমুদ্রভিত্তিক নীল অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে একত্রে কাজ করবে। আর ভবিষ্যৎ সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচনেও তাঁরা কাজ করবেন’। ভারত বাংলাদেশের সমুদ্র গবেষণার সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে গোয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অসেনোগ্রাফি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরেও একমত হয়েছে। উপকূলীয় অন্য আরও কয়েকটি দেশকেও সমুদ্র সহযোগিতায় নিয়ে আসা যায়, এর মধ্যে আছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা।

বেইজিংয়ের ব্যাংক: না, চীনের বিরোধিতা করে ঢাকার সঙ্গে স্থল ও সমুদ্র যোগাযোগের সহযোগিতার রূপরেখা প্রণয়নের কোনো দরকার নেই দিল্লির। চীন-পাকিস্তান পক প্রণালির মধ্য দিয়ে যে অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, ভারত তার বিরোধিতা করেছে। দেশটি উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে তেমন উদ্যোগের ব্যাপারে চীনের সঙ্গে কথাও বলেছে। এদিকে মোদি ও হাসিনা চীনের দক্ষিণ সিল্ক রোড উদ্যোগের ব্যাপারে ইতিবাচক সুরে কথা বলেছেন। চীন যে চারটি দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা আরও বিস্তারিত করতে গত কয়েক বছর ধরে ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন। মোদি ও হাসিনা এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী যে এই স্টাডি গ্রুপ যে সিদ্ধান্ত টানবে, তাতে ‘এই কাঠামোর আওতায় কলকাতা-কুনমিং মহাসড়ক প্রকল্পসহ আরও যেসব প্রকল্প আলোচনাধীন আছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।’

দুই নেতাই এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংককে স্বাগত জানিয়েছেন, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে চীন এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেছে। মোদি যে আবার বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে চীনের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, তাতে দিল্লির প্রথাগত পররাষ্ট্রনীতির ব্যত্যয় ঘটেছে। এটা যদি অতীতে ঘটত, তাহলে ভারত বেইজিংয়ের উদ্যোগের শুধু বিরোধিতাই করত, নিজে থেকে কোনো প্রস্তাব দিত না। কিন্তু মোদি এ ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। তিনি যেমন একদিকে ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন, তেমনি সমস্বার্থের ভিত্তিতে চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো তৃতীয় দেশের সঙ্গেও তিনি কাজ করতে আগ্রহী।



মন্তব্য চালু নেই