নোয়াখালী চৌমুহনীতে শত বছরের বাণিজ্যিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে

নোয়াখালীর চৌমুহনী শহরের রয়েছে শত বছরের বাণিজ্যিক ঐতিহ্য। রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। এক সময় চৌমুহনী শহরের তেল ও প্রকাশনা শিল্প সারা দেশে প্রসিদ্ধ ছিল। দেশের খ্যাতনামা কয়েকটি শিল্প গ্রুপ এই চৌমুহনীতেই গড়ে উঠেছে। তবে মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা ও নানা প্রতিকূলতায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঐতিহ্য।

চৌমুহনী শহরের পুরাতন তথ্যাবলী থেকে এবং প্রবীণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যায়, চৌমুহনী শহরের বড়পুলের নিকট ৪টি খালের সংযোগ স্থানকে কেন্দ্র করে চৌমুহনী নামকরণ হয়। মারোয়াড়ীদের বড় বড় দোকানপাট ও ব্যবসা ছিল চৌমুহনীতে। চৌমুহনীর সঙ্গে দেশের নদী বন্দর চাঁদপুর, ভৈরব, নারায়ণগঞ্জ সহ বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ ছিল। এসব স্থান থেকে বড় বড় সাম্পান ও ডিঙ্গি নৌকায় মাল বোঝাই করে চৌমুহনী আসতো। এখানে ৬টি নৌকাঘাট ছিল। বর্তমানে দখলদারদের কবলে পড়ে একটি ঘাটও নেই। খাল ভরাট করে দোকানপাট এমনকি বহুতল ভবন নির্মাণ করায় নৌ-যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। রেল যোগাযোগ ছিল অনেক উন্নত। প্রতিদিনই মালবাহী গাড়ি আসতো। চৌমুহনী সরকারি খাদ্যগুদামে কয়েক শ’ শ্রমিক কাজ করতো।

রেল সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের (বর্তমানে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ) মধ্যে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে চৌমুহনী রেলস্টেশন প্রথম স্থান অর্জন করেছিল। রেল বিভাগের চৌমুহনীতে ৪০ একর জায়গা রয়েছে। বর্তমানে স্টেশন ভবন ও রেললাইন ছাড়া কোন জায়গা রেলের হাতে নেই। এমনকি রেলওয়ে কোয়ার্টারও বহিরাগতদের দখলে।

তেলশিল্প: ১৯৪৯ সালে উপেন্দ্র কুমার সাহা চৌমুহনীতে শ্রী গোপাল অয়েল মিল (লাড্ডু গোপাল) স্থাপন করেন। পরে চৌমুহনীতে ৩২টি তেলের মিল স্থাপিত হয়। একসঙ্গে এত সংখ্যক তেলের মিল তখনকার সময় কোথাও ছিল না। চৌমুহনীর তেল তৎকালে পশ্চিম পাকিস্তানেও রপ্তানি হতো। কালক্রমে বিভিন্ন সমস্যায় বেশির ভাগ তেলের মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি রয়েছে। সর্বপ্রথম যে মিলটি স্থাপিত হয়েছিল, সে মিলটি আজও রয়েছে।

প্রকাশনা শিল্প: দেশের প্রকাশনা জগতে চৌমুহনী একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ধরে রেখেছে। চৌমুহনী থেকে শুরু করে দেশের আজ শীর্ষস্থানীয় প্রকাশক হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছে। ১৯৪৫ সালে মৃত চিত্ত রঞ্জন সাহা চৌমুহনীতে বাসন্তি প্রেস প্রতিষ্ঠা করে ছাপার জগতে ঢুকেন। পরে তিনি পুঁথিঘর প্রতিষ্ঠা করে প্রকাশনা শুরু করেন। পুঁথিঘর থেকে প্রকাশিত অধ্যাপক হরলাল রায়ের “বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা” দেশব্যাপী ছাত্রছাত্রীদের নিকট সমাদৃত ছিল। এর আগে চৌমুহনীর ইসলামিয়া লাইব্রেরি ১৯৩৯ সালে ধর্মীয় প্রকাশনায় হাত দেয়। পরে আজিজিয়া লাইব্রেরি, শরীফিয়া লাইব্রেরি, রেজ্জাকিয়া লাইব্রেরি, বই প্রকাশনী, বাংলাদেশ প্রকাশনী, রেখা প্রকাশনী, পপুলার লাইব্রেরি, সাহিত্য ভবন, মিতা প্রকাশনীসহ অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঢাকাস্থ বাংলাবাজারে রয়েছে।

এদিকে পুঁথিঘর লিঃ-এর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা মুক্তধারার মাধ্যমে চার শতাধিক বই একসঙ্গে প্রকাশ করতে যেয়ে হোঁচট খান।

মুদ্রণ শিল্প: চৌমুহনীতে প্রায় একশ’ অফসেট প্রেস রয়েছে। বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রথম অফসেট প্রেস এখানেই স্থাপিত হয়। মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির সম্পাদক আশরাফ ছিদ্দিকী বাবু বলেন, বিগত শতাব্দীর ৪০-এর দশক থেকে চৌমুহনী প্রকাশনা শিল্প শতাধিক প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে বিলুপ্ত হতে চলেছে জন্ম নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। এ শিল্পের প্রধান উপকরণ কাগজ ও রং-এর মূল্যবৃদ্ধি এবং পুঁজির অভাব।

তাছাড়া, ব্যাংক অর্থের যোগান দিতে অনীহার কারণে এ শিল্পে সংকট দেখা দিচ্ছে। কল্পনা প্রেসের কর্ণধার সাহাব উদ্দিন বলেন, ১৯৮১ সালে এক সংকটময় মুহূর্তে আমাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির জন্ম। ৫০-এর দশক থেকে এখানে সমিতির চর্চা হয়ে আসছে। সমিতির ভূতপূর্ব স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন সাহা ও মরহুম আলহাজ মমতাজ উদ্দিন সাহেব সমমনা ৩৬ জনকে সংগঠিত করে ৩৮ জন ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। তারাই সংঘবিধি ও সংঘ স্মারক তৈরি করেন। মাইজদী ও চৌমুহনী শহরের নামে নোংরা রাজনীতি থেকে সমিতিকে মুক্তির অবসান চান তিনি। চৌমুহনীতে বিসিক শিল্প নগরীতে ৭৪টি শিল্পকারখানা চালু রয়েছে, আরো কয়েকটি চালুর অপেক্ষায় আছে। এছাড়া শহরে ২২টি মেজর ফ্লাওয়ার মিল ছাড়াও শতাধিক ক্ষুদ্র শিল্প রয়েছে। চৌমুহনীতে রয়েছে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ডেলটা জুট মিল লিঃ।

এছাড়া প্রায় ১০ হাজার দোকানপাট রয়েছে। পাইকারি ব্যবসাই প্রধান। অথচ চৌমুহনীতে মালামাল বোঝাই ও খালাস করার কোন স্থান নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে রাস্তায় মালামাল বোঝাই ও খালাস করে থাকে। এতে যানজট লেগেই থাকে। বাসের বেলায়ও একই অবস্থা। করিমপুর রোডে লোকাল বাসস্ট্যান্ড থাকলেও স্থান সংকুলান হয় না। আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড না থাকায় রাস্তার ওপর বাসের যাত্রী ওঠানামা করতে হয়।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা: বৃহত্তর নোয়াখালীতে ফেনী কলেজের পর চৌমুহনী কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৪৩ সালে। পরবর্তীতে কলেজটি ১৯৮৬ সালে সরকারিকরণ হয়। উক্ত কলেজে বর্তমানে ১১ বিষয়ে সম্মান শ্রেণী রয়েছে। আরো ৪ বিষয়ে সম্মান শ্রেণী চালুর প্রক্রিয়া রয়েছে। কৃষি প্রশিক্ষায়তন, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়াও বেসরকারি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় এসএসসি পরীক্ষায় জেলায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে।

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক: পাক আমলে শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় জেলা দলের ১১ জনের মধ্যে ৬ জনই ছিল চৌমুহনী তথা বেগমগঞ্জের। স্বাধীনতা-উত্তর কালেও জাতীয় নাট্য প্রতিযোগিতায় চৌমুহনীর কোন নাট্য গোষ্ঠী জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করতো। সবদিক উন্নত থাকলেও চৌমুহনী তথা বেগমগঞ্জে জায়গা বরাদ্দের অভাবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এতে চৌমুহনীবাসী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজনীতি-বাণিজ্যিক দিক দিয়ে যেমন চৌমুহনীর ঐতিহ্য রয়েছে, তেমনি রাজনীতির দিক দিয়েও বৃহত্তর নোয়াখালীর মধ্যে চৌমুহনীর গুরুত্ব ছিল প্রথমে। গত শতাব্দির চল্লিশের দশকের প্রথমদিকে নোয়াখালী জেলা শহর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে জেলা শহর স্থাপন করার জন্য চৌমুহনীতে ৬১০ একর ভূমি হুকুম দখল করে।

জেলা সদর দপ্তর স্থাপন নিয়ে চলে নানাবিধ ষড়যন্ত্র। সাবেক পাক মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী নাজিমউদ্দিন ছিলেন ফেনীর বাসিন্দা। তিনি চেয়েছিলেন ফেনীতে জেলা সদর স্থাপন করার এবং যাবতীয় ক্রিয়াকর্মও সম্পন্ন করেছিলেন। ১৯৬০ সালের ১০ই জানুয়ারি ফেনীতে জেলা সদরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার দিন নির্ধারণ করেন। এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও গভর্নর নুরুল হকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চৌমুহনীতে প্রধান সড়কের রেল গেট বন্ধ করে দিয়ে অবস্থান নিয়ে ফেনী যাবার পথ আটকে দেন।

নোয়াখালী থেকে কোন সরকারি কর্মকর্তা সেদিন ফেনীতে যেতে পারেননি। আজম খান ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন না করেই ঢাকা চলে যান। পরে চৌমুহনী ও মাইজদী শহরের নেতৃস্থানীয়দের আলোচনায় চৌমুহনী সমপ্রসারণ হবে দক্ষিণ দিকে, মাইজদী সমপ্রসারণ হবে উত্তরদিকে উভয় শহর এক হয়ে যাবে এই সমঝোতার ভিত্তিতে মাইজদীতে জেলা সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। বর্তমানে চৌমুহনীতে প্রশাসনিক দিক ছাড়া ব্যবসাসহ অনেক বিষয়ে চৌমুহনীর ঐতিহ্য অটুট রয়েছে। চৌমুহনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। ১৯৫৯ সালে তৎকালে নোয়াখালীর প্রথম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন করে চৌমুহনীতে।

১৯৭৩ সালে চৌমুহনী পৌরসভা ঘোষিত হয়। কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর এ ক্যাটিগরির পৌরসভায় উন্নীত হলেও নাগরিক সুবিধার উন্নতি হয়নি। কাদা আবর্জনার গর্তের জন্য চৌমুহনী শহরে পায়ে হেঁটে চলা যায় না। সর্বোপরি চৌমুহনী শহরে আন্তঃ জেলা বাস ও ট্রাক টার্মিনাল এবং মালামাল বোঝাই ও খালাসের স্থান নির্ধারণ করা, জবরদখলকারীদের হাত থেকে ভরাটকৃত খালগুলো উদ্ধার করে নৌ-চলাচল ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করায় হারিয়ে যাচ্ছে শত বছরের চৌমুহনী শহরের ঐতিহ্য।



মন্তব্য চালু নেই