নাস্তিকদের ধর্ম, আস্তিকদের উৎসব

বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে গেলে যে কয়টি গুণ থাকতে হবে তার অন্যতম- আপনাকে আস্তিক হতে হবে। অর্থাৎ বিশ্বাস করতে হবে ঈশ্বরকে। অদৃশ্য সেই নিয়ন্ত্রককে মনে-প্রাণে ডাকতে হবে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার সঙ্গে আস্তিকতার সম্পর্ক বা এটিই যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে কিনা সে হিসেব পরেই করা যাক। হিসেব একটাই, নাস্তিক হয়েছেন তো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা আপনার নেই। এমন একটি তথ্য জানার পর আসলে আমাদের বা আপনার আমার খুব বেশি কিছু আসবে-যাবে না। তবে নাস্তিকরা একটু চটে যেতে পারেন। তারা কিসে বিশ্বাস করবেন বা না করবেন সেটি প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্যতা হবে কেন?

শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, অনেক দেশেই অলিখিতভাবে আস্তিকতা বিষয়টি জনজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্রে এখনও ধর্ম হিসেবে নাস্তিক লেখার সুযোগ আসেনি। তাই নিজে অবিশ্বাসী হয়ে উঠলেও বাপ-দাদাদের ধর্মটি কোনও না কোনও সময় ফর্মে লেখতেই হয়। আর সেটি ধরেই জীবন চালাতে হয়।

ধরা যাক, আপনি ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে ঘোর অবিশ্বাসী, কিন্তু আপনার বাবা চরম বিশ্বাসী একজন ব্যক্তি। যতটুকু সম্ভব ধর্মকর্ম তিনি পালন করেন। ধর্ম অনুযায়ী আপনার নাম রাখলেন। যেহেতু জন্ম আর নাম রাখায় কারও হাত থাকে না তাই এর আফটার ইফেক্টটাও মেনে নিতে হয়। আরও ধরে নিচ্ছি আপনি একটি কট্টর মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছেন, আপনার নাম আবদুল্লাহ রাখা হয়েছে। বেশ বড় বয়স পর্যন্ত এই নামেই আপনি পরিচিত হয়েছেন। তাই যখন আপনার আস্তিকতাবোধ জন্ম নিয়েছে তখন চাইলেই আপনি নিজের পরিচিত নামটি বাদ দিতে পারছেন না। তাই এই নামের কারণেই আপনার নাস্তিকতা বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।

এতক্ষণ কিছু অহেতুক গল্প লিখলাম। এত কিছু থাকতে কেন আস্তিকতা বা নাস্তিকতা নিয়ে লিখছি তা জানতে নিশ্চয় পাঠক অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। ওঠাটাই স্বাভাবিক। আসলে হালে ‘ধর্ম’, ‘অধর্ম’, ‘বিধর্ম’, ‘না ধর্ম’ এতটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আর বিশ্বাসের ওপর অবিশ্বাসীদের আঘাত আর অবিশ্বাসীদের ওপর বিশ্বাসীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার হার এত বেড়েছে যে আতঙ্ক লাগে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে দু-কথা লিখতে ইচ্ছা করে।

আপনি অবিশ্বাসী আর আমি বিশ্বাসী তাতে কি কারও কিছু আসে যায়? কিংবা আমিই থাকলাম অবিশ্বাসীদের তালিকায়- আপনি একজন বিশ্বাসী তাতেও কি কিছু যায় আসে? আসে না। তবু আমরা অহেতুক ধর্ম –অধর্ম কপচিয়ে যাই। অনেকে এই ধর্মকে উপজীব্য করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি।

এখন আসুন কিছুক্ষণ নাস্তিকতা নিয়ে কথা বলি। স্রষ্টাকে অবিশ্বাস করে প্রকৃতিকে যৌক্তিক গুরুত্ব দেওয়াটাই নাস্তিকদের মূল বিশ্বাস। সম্পূর্ণ ভৌত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করেন তারা। যেহেতু তারাও একটা কিছু অনুসরণ করেন, সেহেতু তাদের অবিশ্বাসী বলা যায় না। বরং আস্তিক্যবাদের বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয়, অবিশ্বাস ও যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে খণ্ডন নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতি এখানে মুখ্য। ইংরেজি এথিজম শব্দটি ল্যাতিন এথোস থেকে এসেছে। তারাই এথোস যারা ঈশ্বর নেই বলে বিশ্বাস করে এবং ভ্রান্ত ধারণা বলে স্বীকার করে।

এখন ধরে নেই, ঈশ্বর নেই। তবে ঈশ্বরকে ঘিরে এত রীতি-নীতি, আচার-ধর্ম ও আনন্দ উৎসব কিন্তু থেমে নেই। ৩০ দিন রোজার পর একদিনের ঈদ ঘিরে মুসলিম প্রধান দেশগুলোয় কত আয়োজন। বিশেষ উৎসব ভাতা, কেনাকাটা, দাওয়াত, বিশেষ ছুটি সবকিছুই থাকে ঈদ, পুজা, ক্রিসমাস ডে’র মতো বড় বড় উৎসবকে ঘিরেও সেসব থাকে।

এখন মজার বিষয় হচ্ছে, নাস্তিকরা আর যাই করেন উৎসবকে কিন্তু অস্বীকার করেন না। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ থিওরিতে বেশ জাঁকিয়ে ঈদ বা অন্য ধর্মীয় আয়োজন পালন করতে বসে যান তারা। এখন পর্যন্ত বোধহয় এমন নাস্তিক পাওয়া যায়নি যিনি অস্বীকার করেছেন মুসলমানদের ঈদ কিংবা হিন্দুদের দুর্গা পূজা উপলক্ষে বরাদ্দ করা বোনাস নিতে। বরং বেশ আগ্রহের সঙ্গেই ধর্মীয় আয়োজনগুলোয তাদের আগ্রহ কোনও বিশ্বাসীদের চেয়ে কম দেখা যায় না।

ঈদের দিন সকালে সেমাই, দুর্গা পূজার বিজয়া দশমীতে লাড্ডু কিংবা যিশুর জন্মদিনের কেক খেতে খেতে বেশ জাঁকিয়ে ধর্মের অযৌক্তিকতা নিয়ে একটা স্ট্যাটাসও দিয়ে দেন অনেকে। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি ভুলে যান, সেদিনই উৎসব ভাতা নিয়েছেন। তখন তিনি ব্যস্ত থাকেন মুহাম্মদ (স.), ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কিংবা যিশু খ্রিস্টের তাবত ভুলত্রুটি অন্যদের ধরিয়ে দিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আস্তিকদের প্রধান কাজ এখন ধর্মকে অবজ্ঞা করা। একজন হিন্দু মুসলমানকে নামাজ পড়ার জন্য জায়নামাজ এগিয়ে দিচ্ছেন-এমন দৃশ্য আমরা অনেক দেখেছি। উপমহাদেশে ধর্মকে উপজীব্য করে খুব বড় কয়েকটি দাঙ্গার ঘটনা ছাড়া এখানে সব ধর্ম মিলেমিশেই থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নাস্তিকদের ধর্মে অবিশ্বাস বাড়ার পাশাপাশি বিদ্বেষ বাড়ার হারটা আতঙ্কিত করছে।

এখন নিশ্চয় পাঠক বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। ঈদের ছুটিতে নাস্তিকতা নিয়ে কপচানোর কী আছে? ধার্মিক বা বিশ্বাসীরা কী এমন করেছে তাদের নিয়ে সাফাই গাইতে হবে? আসলে ধর্ম-অধর্ম কথাগুলো সময়ের প্রয়োজনে উঠে আসে। বাংলাদেশের নাস্তিকতার একটি ধারা রয়েছে। খুব সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখবেন আপনার আশেপাশের আস্তিকদের ধর্মের প্রতি বিষেদগার বা অবহেলা সবই এক শব্দে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’। ঘুম থেকে উঠে আল্লাহ ও মুহাম্মদের (স.) অবমাননা করে আবার ঈদের সালামি ও কেনাকাটায় কোনও অবহেলা নেই তাদের।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমকামিতার বৈধতা দেওয়ায় গোটা বাংলাদেশে উৎসবের বান ডেকে গেল। বুঝে না বুঝে সবাই মার্ক জুকারবার্গকে অনুসরণ করে প্রোফাইল ছবি সমকামীদের সমর্থনে রঙধনুতে রাঙিয়ে নিলেন। এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্কের দেখাও মিলেছে। যেহেতু ধর্ম সমকামিতাকে সমর্থন করে না সেহেতু নাস্তিকদের বেলায় এই অবস্থান বেশ স্পষ্ট ছিল। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে বেশ উদ্বেলিত ছিলেন। বিষয়টাকে অনেকটা ‘দাদা বলেছেন শালার ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই’-এর মতো ধরে নেওয়া যেতে পারে।

১২ হাজার মাইল দূরের একটি দেশ সম-অধিকার রক্ষার আদর্শে উৎসাহিত হয়ে সমকামীদের বৈধতা দিয়েছে, তাতে এদিকেও যেন আনন্দের সীমা নেই। মজার বিষয় এই যে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই একজন সমকামী আইনি বৈধতা পেলেও রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কেউ হতে পারবেন না। কারণ, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী তাকে আস্তিকই হতে হবে এবং ঈশ্বরের শপথ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে। নাস্তিকদের জন্য এরচেয়ে স্ববিরোধী আর কী হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রেরই স্ববিরোধিতা দেখুন না, যেখানে বর্ণবাদ এখনও প্রকট, কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকার এখনও অনিশ্চিত। ইচ্ছা হলেই গির্জা বা বাড়িতে ঢুকে অথবা অবৈধ অনুপ্রবেশের দাবি তুলে কৃষ্ণাঙ্গদের গুলি করে মেরে ফেলা যায়। শতাধিক কৃষ্ণাঙ্গ মেরে ফেলার পর বিচার বিভাগ আপনাকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে স্বীকৃতি দিবে এবং আপনার শাস্তি হবে উন্নত মানসিক চিকিৎসা। এখানে বোধহয় যুক্তরাষ্ট্রের স্ববিরোধিতার কথা আর আর না বলাই ভালো।

উৎসব আয়োজনের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া হলো। কিন্তু বিশ্বের সব দেশে রাষ্ট্রীয় আচারে ধর্মের আধিক্য এত বেশি প্রকট যে অবিশ্বাসী হয়েও একজন আস্তিকের আচার অনুসরণ করেই চলতে হয়। আপনি চাইলে আরেকজনের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে তার খোদা ও ঈশ্বরকে ‘ধুয়ে ফেলতে’ পারেন। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় যস্মিন দেশে যদাচার মেনে নিয়ে বিসমিল্লাহ কিংবা পরম করুণাময় স্রষ্টার নামে শুরু করতেই হয়। এখন নিশ্চয় নাস্তিকদের জন্য আস্তিকদের খুব করুণা হচ্ছে। এমন অবিশ্বাসের ঘোরটোপ তৈরি করেছেন যে, সেটি পালন করার কোনও সুযোগই নেই। আস্তিকের পোশাক পরেই ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে।

তবে আপনি ধার্মিক, আস্তিক, নাস্তিক যাই হন না কেন, অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করার যে প্রচলন শুরু হয়েছে তা নিয়ে বোধহয় ভাবার সময় এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন স্বঘোষিত নাস্তিক সমকামিতার সমর্থনে রেইনবো ফ্ল্যাগ নিলেন প্রোফাইলে। পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের পবিত্র স্থান কাবাঘরকেও রাঙিয়ে দিলেন। এতে তার অবিশ্বাসের চর্চা বেশ হয়েছে হয়ত, কিন্তু যারা বিশ্বাস করেন তাদের মনে কেমন আঘাত লেগেছে তা কী একবার ভেবেছিলেন? ঈদের সালামি নিচ্ছেন, বোনাস-ভাতা নিচ্ছেন, ঈদ উপলক্ষে প্রচারিত সব অনুষ্ঠান গোগ্রাসে গিলেও ফেলছেন। অথচ তাদের স্রষ্টাকেই ঝেড়ে দিচ্ছেন। সমঅধিকার আর যুক্তিতে এত বিশ্বাসী আপনি এটুকুও নিশ্চয় মেনে নিবেন যে, অবিশ্বাস করাটা যেমন অধিকার, বিশ্বাস করাটাও অধিকার।

লেখক:  ফাতেমা আবেদীন, সাংবাদিক।

ইমেইল: [email protected]



মন্তব্য চালু নেই