নন এমপিও শিক্ষকদের অপরাধ কী?

ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। নেপোলিয়ান বলেছেন, ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’ শিক্ষাই পারে জাতিকে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে আলোর দিকে ফিরিয়ে আনতে। শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গড়ার কারিগর। মা-বাবা সন্তান জন্ম দেয়, আর শিক্ষক তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।

শিক্ষকদের উন্নয়ন ব্যতীত একটি জাতির উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। যে সকল দেশ উন্নতির শিখরে আরোহন করেছে, সে সকল দেশের শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়। আমরা আমেরিকা-ইউরোপের দিকে একটু নজর দিলে দেখতে পাই, সে সকল দেশের শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা অন্যান্য পেশা থেকে অনেক বেশি। যার ফলে মেধাবীরা শিক্ষকতার দিকে ঝুকছে।

অন্যদিকে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ন উল্টো। মেধাবীদের শিক্ষকতার দিকে নেওয়া যাচ্ছে না। কারন, আমাদের দেশে শিক্ষকদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এ পেশা পুরোপুরি অবমূল্যায়িত, অবহেলিত। আমাদের দেশে বলা হয়, যার নাই কোনো গতি সে করে মাস্টারি।

আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ ননএমপিও শিক্ষক রয়েছে, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। যারা বছরের পর বছর অকপটে জ্ঞান বিতরন করে যাচ্ছে। আমার দেখা আনেক শিক্ষক রয়েছে যারা ১৫-২০ বছর যাবৎ নিজেদের গতর খাটিয়ে জ্ঞান বিতরন করছে। কিন্তু তাদের কোনো পারিশ্রমিক নেই। আজ তাদের হাহাকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে।

গত কয়েক বছর পূর্বে একটি জাতীয় দৈনিকের এক প্রতিবেদনে দেখেছিলাম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিবারের সদস্যদের তিন বেলা আহার জুটানোর জন্য অর্ধেক বেলা প্রতিষ্ঠানে আর বাকি সময় একটি ইটভাটায় শ্রম বিক্রি করে। এরকম অনেক শিক্ষক রয়েছে, যাদের কথা মিডিয়ায় আসে নাই। তাদের কী অন্যায়? তাদের কী বেচে থাকার অধিকার নেই? তারা দেশের মানুষকে জ্ঞান বিতরণ করে উচ্চ শিক্ষিত করে সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ডাক্তার, নার্স, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার জনবল তৈরি করছে, এটাই কি তাদের অন্যায়? আর এসব বড় বড় পেশার লোকজন তাদের বড় চেয়ারে বসে নিজেদের শিক্ষকদের কথা ভুলে যান।

বর্তমান সরকারকে শিক্ষাবান্ধব সরকার বলা হয়। শিক্ষার উন্নয়নে এ সরকার অনেক কিছু করছে। বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি বই দিবস উদযাপন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে বই বিতরন, স্নাতক পর্যন্ত উপবৃত্তি প্রদান। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্নাতকোত্তর পর্যন্ত উপবৃত্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে। সরকার প্রতি বছর শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। এ বরাদ্দ আরেকটু বৃদ্ধি করে প্রতি বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও ফলাফল বিবেচনা করে কিছু কিছু করে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা যেতে পারে যাতে করে ননএমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে আসবে। এসব ননএমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির লক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করে লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের মুখে হাসি ফুটালে অসহায় শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাঠদানে অধিক মনোযোগী হবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হবে। এতে করে শিক্ষিত সমাজে সরকারের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে।বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সর্বশেষ ২০১০ সালে ১৬২৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৪ সালে এমপিওভুক্ত করা হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ নতুন করে এমপিও প্রদান বন্ধ রয়েছে। দেশে সাড়ে সাত হাজারের মতো ননএমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাতে প্রায় এক লক্ষ পঁচিশ হাজারের মতো শিক্ষক রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার ননএমপিও শিক্ষক রয়েছে, যারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।

বর্তমান সরকার দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর এক পরিপত্র জারির পর থেকে কম্পিউটার বিষয়ের অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এমপিও প্রদান অনিবার্য কারনে বন্ধ রাখা হয়েছে। যাদের হাত ধরে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করা হবে, তাদের অভুক্ত রাখা কি ঠিক? আইসিটি তথা কম্পিউটার শিক্ষকদেরকে এমপিওভুক্ত করে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আইসিটি শিক্ষার সুফল বয়ে আসবে এবং তাদের হাত ধরেই দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে। কলেজ পর্যায়ে বানিজ্য বিভাগে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা নামে একটি নতুন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আইসিটি শিক্ষকদের মতো এমপিও প্রদান বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট পদে সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত হাজার হাজার ননএমপিও শিক্ষক রয়েছে। তাদেরও এমপিওর দিনক্ষন কেউ বলতে পারছে না।

বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার এসব অসহায় শিক্ষকদের প্রতি একটু সুদৃষ্টি দিলে, তারা সারাজীবন বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনধারার পরিবর্তন করে একটু সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে। পরিশেষে, আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে দেশকে ও দেশের মানুষের উন্নতি করতে হলে শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষাই পারে দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, আলহাজ্ব আব্বাস উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মিরপুর, ঢাকা।



মন্তব্য চালু নেই