নতুন পে-স্কেলে জনগণের দুর্ভোগের ইঙ্গিত !

আগামী ১ জুলাই থেকে প্রায় ১৩ লাখ সরকারি চাকরিজীবী নতুন কাঠামোতে বেতন পেতে যাচ্ছেন। জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা শেষে গেল ১৩ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি অর্থমন্ত্রীর কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে বেতন কাঠামোর ২০টি গ্রেড ঠিক রেখে মূল বেতন সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার এবং সর্বনিম্ন আট হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। [মন্ত্রিপরিষদ ও মুখ্য সচিবের বেতন ধরা হয়েছে ৯০ হাজার টাকা (নির্ধারিত) এবং সিনিয়র সচিবের বেতন ৮৪ হাজার টাকা (নির্ধারিত)] মূল বেতনের সাথে অন্যান্য ভাতাও নিয়মানুযায়ী যুক্ত হবে। অতীতের ন্যায় এবারও দুই ধাপে বাস্তবায়ন হতে পারে এই বেতন কাঠামো এমনটিই ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

এর আগে ২০১৩ সালের ২৪ নভেম্বর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সদস্যরা প্রায় ১৩ মাস কাজ করার পর গেল ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নতুন বেতন কাঠামোর প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে সরকারি চাকরিজীবীদের শতভাগ বেতন বাড়ানোর অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন আট হাজার ২০০ টাকা মূল বেতন নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

এছাড়া বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে বেতন কাঠামো চালু আছে তা ২০০৯ সালে করা হয়েছিল। তখন সরকারি চাকরিজীবীদের সর্বনিম্ন বেতন ছিল ৪ হাজার ১০০ এবং সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা (বেসিক) করা হয়েছিল। যেখানে আগের চেয়ে সর্বোচ্চ ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছিল। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা পাচ্ছেন, যা ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়।

সচিব কমিটির প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে সর্বনিম্ন ধাপে শতভাগেরও বেশী বেতন বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মহাখুশি। সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীও খুশিতে গদগদ। গত বুধবার বিকেলে সচিব কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় অর্থমন্ত্রী হাসতে হাসতে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, প্রতিবেদনটি ভালোই হয়েছে।’

নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা হলে তা বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলেও দাবি করেন তিনি। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যায়, এবারও সে রকম কিছুর আশঙ্কা করেন কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি এ ধরনের বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। এটা আপনারা কাগজে লেখেন। ইটস টাক্স এ স্নো-বল প্রসেস। এটা কোনো ইমপেক্ট হয় না।’

আসলে কী তাই! দক্ষ অর্থমন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে আমাদের খুশি হবার মতো কী কোনো কারণ রয়েছে, না এর মধ্যে দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য দুঃখ-দুর্দশার অশুভ ইঙ্গিত বহন করছে? তা এখন আমাদের সবার ভেবে দেখার সময় এসেছে। কেননা, এই অর্থমন্ত্রীই গেল মেয়াদের প্রথম দিকে ‘শেয়ারবাজার আগের অবস্থানে নেই, এখন আমরা অনেক সচেতন, কেউ ইচ্ছা করলেই আগের মতো কারসাজি করতে পারবে না’ এই বলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করে বাজারে আনেন এবং পরবর্তীতে তাদেরকেই ধাপ্পাবাজ অসৎ স্টুপিট বলে গালি দিয়ে পথে বসিয়েছেন। এই সেই অর্থমন্ত্রী যিনি হলমার্কের চারহাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারীকে টাকার অংকে কিছুই না বলে আখ্যায়িত করে দুর্নীতি উৎসাহিত করেন। ফলে এই সুদক্ষ অর্থমন্ত্রীর কথায় আমরা কোনোভাবেই আস্থা রাখতে পারি না।

প্রসঙ্গত, নির্দিষ্ট সময়ের পর পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়। এতে কারো অখুশি হবার কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু সেটা যদি মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে গিয়ে রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর জীবনে দুর্দশা নিয়ে আসে সেটাই ভাববার বিষয়। সেখানেই সবার আপত্তির বিষয়। আমার আজকের আলোচনার ক্ষেত্রও সেই জায়গায়। ফলে আলোচনা করা যেতে পারে এই নতুন বেতন কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক কী কী দিক রয়েছে-

Salary

প্রথমত: এই বেতন কাঠামো খোদ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেই ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করবে। কেননা, নতুন বেতন কাঠামোয় প্রথম গ্রেডের কর্মকর্তারা খুশি হলেও মাঝারি গ্রেডের কর্মকর্তারা খুশি হতে পারেননি। অন্যদিকে নিম্নপদের কর্মচারীরা নতুন বেতন স্কেলে ডাবল বেতন পাওয়ার খবরে সাময়িকভাবে খুশি হলেও স্বল্প দিনের মধ্যেই তাদের এই আনন্দ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী। কেননা, বাজারে ব্যাগ নিয়ে পণ্য কিনতে গেলেই তারা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

দ্বিতীয়ত: নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা হলে তা বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না অর্থমন্ত্রীর এমন দাবি কতটা বাস্তবসম্মত তা আমার কাছে কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। কেননা, আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। কারণ অতীতে যতবারই নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা হয়েছে ততবারই দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এক্ষেত্রে এবারও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে বলে আস্থা রাখতে পারছি না। এছাড়া গেল ডিসেম্বরে কমিশন নতুন বেতন কাঠামোর সুপারিশ জমা দেয়ার পর পণ্যের দাম কমেছে না আরো বেড়েছে তা একটু খতিয়ে দেখতে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে আমাদের মতো একদিন বাজারে ব্যাগ নিয়ে গিয়ে পণ্য কিনে দেখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমার জানা মতে, গেল ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সব ধরনের পণ্যের দাম কমবেশী বেড়েছে। ফলে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা হলে যে সব ধরনের পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে এতে অন্তত: আমার কোনো সন্দেহ নেই।

তৃতীয়ত: আমরা জানি, নতুন বেতন কাঠামো কার্যরকর হলে ১৩ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এই সুবিধা পাবেন। এর মধ্যে চাকরিতে সক্রিয় ১১ লাখ এবং অবসরকালীন ২ লাখ এ সুবিধা পাবেন। কিন্তু আমাদের দেশে তো বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠী ১৭ কোটিরও উপরে। ফলে এই ১৩ লাখ লোকের সুবিধার বিনিময়ে যদি বাকী ১৭ কোটি মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে তার দায় কে নেবে? ফলে ১৭ কোটি মানুষের দুর্ভোগের মধ্যে এই ১৩ লাখ লোকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন তথা সুখ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে বলেই মনে করি।

চতুর্থত: অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই নতুন বেতন কাঠামো দেশে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টির করবে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই এটা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই সাময়িক আনন্দ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

পঞ্চমত: এই বেতন কাঠামো সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠী যারা বেসরকারি খাত থেকে প্রাপ্ত আয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদেরকে যে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিবে এতেও কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, ১ জুলাই থেকে এই বেতন কাঠামো চালু হলে বেসরকারি খাতে যারা কর্মরত তাদের হঠাৎ আয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এতে সর্বত্রই এক ধরনের বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠী চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে। তখন কী হবে! সেটা কী আমাদের রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা একুট ভেবে দেখেছেন?

ষষ্ঠত: এই বেতন কাঠামো দেশে দুর্নীতির বিস্তার করবে। এটা ঘটবে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই। কেননা, দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই সমাজের সর্বত্র এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন আমাদের দেশের মানুষ যতটুকু সততা নিয়ে বেঁচে আছে তাও হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে। আর এতে যা হবার তাই ঘটবে রাষ্ট্রের সর্বত্র।

পরিশেষে বলবো, এই নতুন বেতন কাঠামো বাজারে প্রভাব ফেলবে না, অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য অর্থনীতির প্রচলিত থিওরিতে কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। তাই অনুমোদনের আগে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাবো, দয়া করে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে পুনর্বিবেচনা করে একটি ন্যায় সঙ্গত যৌক্তিক বেতন কাঠামো তৈরির ব্যবস্থা নিন। অন্যথা সমাজের সর্বত্রই এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা যারা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তারাও তো এই রাষ্ট্রের নাগরিক। ফলে সমাজের ক্ষুদ্র অংশকে খুশি করতে গিয়ে আমাদেরকে (বৃহৎ জনগোষ্ঠী) দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয়া কোনোভাবেই সরকারের উচিৎ হবে না।

আমরা নতুন বেতন কাঠামোর বিপক্ষে নই, আমরাও চাই সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনযাত্রার মানোন্নোয়নের লক্ষ্যে তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হোক। কিন্তু সেটা হতে হবে যৌক্তিক। যাতে রাষ্ট্রের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কষ্টের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। আশা করি, সরকার এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। আর এতে জনগণের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সরকারেরই কল্যাণ সাধিত হবে।



মন্তব্য চালু নেই