নওগাঁর পোরশায় পথিকদের জন্য আজও টিকে রয়েছে মুসাফিরখানা

কাজী আনিছুর রহমান, রাণীনগর (নওগাঁ) : শতবর্ষ পূর্বের কথা। উঁচু-নিচু বরেন্দ্র ভুমি। বন-জঙ্গলে ঘেরা। যখন হেঁটে চলতো পথিক মেঠোপথে। চলতে চলতে দুপুর হয়, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। পথে যখন বাঘ- ভালুকের ভয়, চোর-ডাকাতের উপদ্রব। মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে লোকালয় খোঁজে। কারও ভাগ্যে নিরাপদ আশ্রয় মেলে, আবার কারও ভাগ্যে মেলে ভোগান্তি। মানুষের এমন ভোগান্তি আর কষ্টের কথা চিন্তা করে এখন থেকে শত বছর পূর্বে তৎকালীন এখানকার জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ তৈরি করেছিলেন একটি মাটির ঘর।

তিনি ঘরের নাম দিয়েছিলেন মুসাফিরখানা। যেন বাইরের মানুষ বিপদে-আপদে এখানে এসে আশ্রয় পান। পথিকের রাত বা দিনে বিশ্রামের জন্যই এটি নির্মান করা হয়েছিল। পথিকের রাত বা দিনে থাকার পাশাপাশি খাবারেরও ব্যবস্থা করেছিলেন জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ। থাকা এবং খাওয়া সবগুলিই একেবারেই বিনামূল্যে। পরিচালনা এবং সকল ধরনের খরচ চালানোর জন্য তিনি মুসাফিরখানায় দান করে দিয়েছিলেন ৮০বিঘা জমি। দানকৃত ঐ ৮০ বিঘা জমি থেকে বর্তমানেও মুসাফিরখানার খরচ চালানো হয়ে থাকে।

উন্নত রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ এবং দ্রুতগামী যানবাহনের আধুনিক যুগেও টিকে রয়েছে নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলার পোরশা সদরের মুসাফিরখানাটি। দূর-দূরান্তের পথিকদের আগের মতোই স্বাগত জানায় এ মুসাফিরখানাটি।

জেলা শহর নওগাঁ থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ১০০শ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কোনে পোরশা উপজেলা। পোরশা উপজেলা পরিষদের সকল দপ্তর, থানা ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সবগুলিই পোরশা সদর থেকে ৫কিলোমিটার পশ্চিমে নিতপুর নামক স্থানে। আর মুসাফিরখানাটি পোরশার সদরের মিনা বাজারে অবস্থিত।

বয়জৈষ্ঠ ব্যাক্তিদের নিকট থেকে জানা যায়, প্রায় ১৫০০ সালের পরে কোন এক সময়ে তৎকালীন বাদশা আলমঙ্গীরের আমলে ইরান থেকে হিজরত করতে বাংলাদেশের বরিশালে আসেন কয়েকজন শাহ বংশের মুরব্বী। এদের মধ্যে ফাজেল শাহ, দ্বীন মোহাম্মদ শাহ, ভাদু শাহ, মুহিদ শাহ, জন মোহাম্মদ শাহ, খান মোহাম্মদ শাহ অন্যতম। পরবর্তীতে বরিশাল থেকে তারা আসেন বর্তমান পোরশা সদরে। যদিও তখন এখানে কোন বসতবাড়ি ছিলনা। ছিল শুধু বন-জঙ্গল।

এলাকাটি ভাল লাগায় তারা এখানে ঘর বাড়ি নির্মান করে বসবাস করতে শুরু করেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে স্ত্রী-সন্তানও ছিল। পরবর্তীতে তাদের সন্তানদের তাদেরই পরিবারের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বংশ বিস্তার করান। এ প্রথাটি আর্থাৎ নিজেদের বংশের মধ্যে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রথাটি বর্তমানেও চালু রয়েছে পোরশায়। এখানে বসবাস করার পর থেকে এ এলাকার প্রচুর জমিজমা পেয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখানে জমিদারী করেন। এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বর্তমানেও এখানে রয়েছেন। তাদেরই বংশধর খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ যিনি এই মুসাফিরখানাটি নির্মান করেছিলেন।

পোরশা সদরের মিনা বাজারের বড় মসজিদের নিকটেই মুসাফিরখানাটি অবস্থিত। রাস্তার সাথে লাগানো পূর্ব-পশ্চিম লম্বা দোতলা ভবন। ভিতরে প্রবেশের আগেই রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। এতে একসাথে মোট ৬০জন থাকতে পারবেন। এদের সকলের থাকার সাথে খাবারও ফ্রী। মুসাফিরখানা পরিচালনার জন্য কর্মচারী রয়েছেন ১জন ও ম্যানেজার রয়েছেন ১জন। এটি পরিচালনার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ পোরশা বড় মাদ্রাসার মহা-পরিচালক আলহাজ্ব শাহ শরিফুদ্দীন চৌধুরী। তিনিই মুসাফিরখানার সকল বিষয়ে খোঁজ খবর নেন এবং দেখাশোনা করেন।

ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি এখানে প্রায় ২০বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিদিন কম-বেশি মানুষ এখানে থাকে। আর তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় ৬০জন মানুষকে একসাথে এখানে রাখার মত ব্যবস্থা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ আলহাজ্ব শাহ শরিফুদ্দীন চৌধুরী জানান, ১৯০৮সালে এটি প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৮০ বছর মাটির ঘরেই এর কার্যক্রম পরিচালনা হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে মুসাফিরখানার জমিজমার আয় দিয়েই বর্তমান ভবনটি নির্মান করা হয়েছিল। প্রতিদিন কম-বেশি এখানে মানুষ থাকে। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। অনান্য দিনের তুলনায় রমজান মাসে এখানে মানুষের ব্যাপক ভিড় হয় বলে তিনি জানান।#



মন্তব্য চালু নেই