‘দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়’

দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে, ‘দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়’ বলে মনে করে দেশের অন্যতম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’। মে মাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় নিহত আহত, শিশু ধর্ষণ, গণ ধর্ষণ,পারিবারিক কোন্দলে আাহত ও নিহত, গৃহকর্মী নির্যাতন ও খুন, নারী নির্যাতন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। মে মাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সহিংসতায় নিহত ৫৯, সামাজিক সহিংসতায় নিহত ৪৩ ও ধর্ষণের শিকার ২১ শিশু।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মে মাসের মনিটরিং এ পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়,

ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় মে’১৬ মাসে নিহত হয় ৫৯ জন এবং আহত হয় ১৩৩২ জন। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সহিংসতায় আহত ও নিহতের সংখ্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারনেই সহিংসতার ঘটনা বেশী ঘটেছে, নির্বাচন কমিশন সহিংসতার দায় এড়াতে পারে না বলে সংস্থা মনে করে। এছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক কারনে আহত হয় ৪৮ জন ও নিহত হন ৪ জন।

সামাজিক অসন্তোষঃ প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এই সবকিছু মিলেই দেশের আপামর জনসাধারনের মানসিক ও মানবিক চিন্তা চেতনার অবক্ষয়ের কারনে বেড়ে গেছে সামাজিক অসন্তোষ আর এই সামাজিক অসন্তোষের শিকার হয়ে এই মাসে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন আহত হয়েছেন ১৪৭ জন। সামাজিক সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দুই মাসে ( মার্চ-এপ্রিল) সেখানে নিহত হয়েছিল ৩২ জন সেখানে বর্তমান মাসে নিহত ৪৩ জন। গাজীপুরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রেতাকে পিটিয়ে খুন করে মুদি দোকানী । বেশীর ভাগ ঘটনাই ঘটেছে জমি জমা , খেলা নিয়ে দুই গ্রামের সংঘর্ষ বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

ধর্ষন : মে মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪০ জন নারী ও শিশু । এদের মধ্যে শিশু ২১ জন। যেখানে বছরের প্রথম তিন মাসে শিশু ধর্ষনের শিকার হয়েছিল ২০ জন। নারী ধর্ষনের শিকার হয় ৭ জন। ৮ জন নারী গণ ধর্ষণের শিকার হয় যা বছরের তিন মাসের গড় গন ধর্ষনের দ্বিগুন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৪ জনকে। শিশু ধর্ষনের ২১ জন শিশুর মধ্যে ১০ জনই ঢাকা বিভাগে ধর্ষণের শিকার হয়। কুষ্টিয়ায়তে নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে এসে গণ ধর্ষণের শিকার হয় এক নারী। লক্ষèীপুরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় মায়া আাক্তার নামে এক শিশুকে।

শিশু হত্যা : মে মাসে ১৪ শিশুকে হত্যা করা হয় । নারায়নগঞ্জে আম গাছে ঢিল মারায় সাত বছরের এক শিশুকে হত্যা করে গাছের মালিক । দিনাজপুরে শিশুকন্যাকে হত্যা করে নিজে আতœহত্যা করে মা। যশোরের বেনাপোলে মুন্না নামে এক হোটেল বয়কে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ঝিনাইদহে সৎ মায়ের হাতে নিহত হয় এক শিশু। নারায়নগঞ্জে সুমাইয়া নামে এক শিশুকে পানিতে ফেলে হত্যা করে মসজিদের এক মুয়াজ্জিন ।

আত্মহত্যা : মে মাসে আত্মহত্যা করেছে ৩৫ জন । এদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ ও ২২ জন নারী। এর মধ্যে ঢাকাতেই আতœহত্যা করে ৮ জন নারী ও ৫ জন পুরুষ, এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা জেলায় আত্মহত্যা করে মোট ১০ জন (নারী ৪ ও পুরুষ ৬)। বাকী ঘটনাগুলো ঘটে বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটে । পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান, রাগ ও যৌন হয়রানীর কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

যৌতুকঃ এ মাসে যৌতুকের কারনে প্রাণ দিতে হয়েছে ৬ জন নারীকে । ঢাকা বিভাগে যৌতুকের বলি হয়েছেন ৪ জন । নারায়নগঞ্জে স্বামী শ্বশুরের দাবিকৃত যৌতুক বাবদ অটোরিক্সা না দেয়ায় লাকি আক্তার নামে এক নববধূকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

পারিবারিক কলহঃ পারিবারিক কলহে মে মাসে নিহত হন ৩৪ জন, এদের মধ্যে পুরুষ ১২ জন, নারী ২২ জন।। এর মধ্যে বিভিন্ন কারনে স্বামীর হাতে নিহত হন ১৮ জন নারী। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ, রাগ, পরকিয়া সহ বিভিন্ন পারিবারিক কারনে এই সব মৃত্যু সংগঠিত হয় বলে জানা গেছে।

খুন : মে মাসে দেশে সন্ত্রাসী কর্তৃক নিহত হন ৭৪ জন ও আহত হয় ৩৮ জন। টাঙ্গাইলে নিখিল জোয়ার্দার নামে এক দর্জিকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা । এ মাসেই বান্দরবনে এক বয়স্ক বৌদ্ধকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা ।

ক্রস ফায়ারে নিহত : এপ্রিল মাসে ক্রস ফায়ারের নামে মৃত্যু হয় ৪ জনের, এর মধ্যে পুলিশের ক্রস ফায়ারে নিহত হয় ৩ জন , র‌্যাব কর্তৃক ১ জন । জেল হেফাজতে ৭ জনের মৃত্যু হয় যেখানে বছরের প্রথম চার মাসে নিহত হয় ১০ জন।। তাছাড়া ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কর্তৃক নিহত হয় ৩ জন। সেখানে বছরের প্রথম চার মাসে সীমান্ত বাহিনী কর্তৃক নিহত হয় ১০ জন।

অন্যান্য সহিংসতার ঘটনাগুলোর মধ্যে, মাদকের প্রভাবে বিভিন্ন ভাবে নিহতের সংখ্যা ৩ জন, আহত হয় ৪ জন। সড়ক দূর্ঘটনায় এ মাসে নিহত ১৯৪ ও আহত ২৯৮ জন। তাছাড়া পানিতে ডুবে, অসাবধানবসত, বিদ্যুৎ স্পৃস্ট হয়ে,বজ্রপাতে মৃত্যুবরন করেছে ১৫৭ জন। গণপিটুনিতে নিহত হয় ১, বোমা বিস্ফোরনে নিহত ৬ জন। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ৪ জনের। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রনের জন্য রাজনৈতিক অজুহাতে ২৪১ জন গনগ্রেফতার হয়েছে ।

‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’ মনে করে বিদ্যমান মানবাধিকার লংঘন অব্যাহত থাকলে একদিকে যেমন দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হবে অন্যদিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গিকার তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে । আইনের সঠিক প্রয়োগ, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নৈতিক অবক্ষয় রোধে বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিলিং, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ভালো কাজের জন্য পুরষ্কার, সামাজিক সংগঠন গুলোর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব বলে মনে করে সংস্থা।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা ৭৯ ধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে। তার মধ্যে প্রতি মাসে আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার তথ্য গনমাধ্যমে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করা হয় । উল্লেখ্য এ মাসে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সার্বিক গবেষনা তথ্য মোতাবেক এসকল ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ ( আহত ও নিহত) হয় মোট ২৮৫৬ জন নারী , পুরুষ ও শিশু।

(তথ্য সুত্রঃ মে ২০১৬ মাসে দেশে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্র-পত্রিকা এবং সংস্থার বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা শাখার মাধ্যমে সংগৃহিত তথ্য। এর বাইরেও মানবাধিকার লংঘন জনিত কিছু ঘটনা থাকতে পারে যা আমাদের সীমাবদ্ধতার কারনে সংগ্রহ করা সম্ভন হয়নি)



মন্তব্য চালু নেই