দেশজুড়ে অপহরণ আতঙ্ক

গত ক’দিনে রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী ও শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজনকে অপহরণ করা হয়েছে। ঢাকায় অপহরণের পর যুবদল নেতা সামছুল ইসলাম সোলায়মানের লাশ পাওয়া গেছে লক্ষ্মীপুরে। রোববার নারায়ণগঞ্জে অপহরণ করা হয়েছে সিটি প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে। একই দিন জেলার এক প্রবীণ আইনজীবী চন্দন সরকার গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হয়েছেন। গতকাল ভোরে গাজীপুরে দুই সহোদরকে অপহরণের পর রাতে উদ্ধার করেছে পুলিশ। একই দিনে ময়মনসিংহের ভালুকায় অপহরণ করা হয়েছে দুই স্কুল শিক্ষককে।
এর আগে অপহরণের ১৩৫ ঘণ্টা পর ফিরে এসেছেন পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এবি সিদ্দিক।

এরকম একেকটি ঘটনা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে জনমনে। গত দু-আড়াই বছরে অপহরণের মামলাসংক্রান্ত পরিসংখ্যানে উল্লেখযোগ্য ওঠানামা নেই। তবে মামলার পরিসংখ্যানের বাইরে অপহরণের ঘটনা রয়েছে অনেক বেশি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণের কৌশল ও অপহৃত ব্যক্তিদের পরিণতি অনেক পাল্টে গেছে। মুক্তিপণ বা সমঝোতায় মুক্তি মিলছে না অপহৃত ব্যক্তিদের। কারো লাশ মিলছে, আবার কেউ কেউ নিখোঁজই থেকে যাচ্ছেন। আর এসব অপহরণের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনার শিকার পরিবার দুষছে র‌্যাব ও পুলিশকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও কমছে না সন্দেহের মাত্রা। সব মিলিয়ে অপহরণ নিয়ে এক ধরনের গোলকধাঁধায় রয়েছে সাধারণ মানুষ।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৬ জন। তাঁদের মধ্যে সাতজনের লাশ পাওয়া গেছে। অপহৃত ১৬ জনের মধ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ছয়জন, জামায়াত-শিবিরের তিনজন, ছাত্রলীগের তিনজন এবং অরাজনৈতিক চারজন। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮ জন অপহৃত হন বলে আসকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ২৪ জনকে। পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে ১৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেই।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র মতে, সারা দেশে গত বছর অপহরণসংক্রান্ত মামলা হয়েছিল ৮৭৯টি। এসবের মধ্যে ঢাকা রেঞ্জে ছিল ১৪৯, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ছিল ১৩০টি। ২০১২ সালে অপহরণসংক্রান্ত মামলা ছিল ৮৫০টি। এসবের মধ্যে ঢাকা রেঞ্জে ছিল ১৫৬, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ছিল ১২২টি। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে অপহরণ ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬২টি, ফেব্রুযারি মাসে ৫৫টি এবং মার্চ মাসে ৭৯টি। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় জানুয়ারি মাসে অপহরণ মামলা হয়েছে ১৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৮টি ও মার্চে ১৫টি। আগের বছর ডিসেম্বর মাসে অপহরণসংক্রান্ত মামলা ছিল চারটি, নভেম্বরে ১৫টি, অক্টোবরে ১২টি, সেপ্টেম্বরে ২৩টি, আগস্টে ১৮টি, জুলাইয়ে ১৪টি, জুনে ১২টি, মে মাসে আটটি, এপ্রিলে ১৪টি, মার্চে ১৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৪টি ও জানুয়ারিতে ১৭টি। বছর ও মাসের ব্যবধানে এসংক্রান্ত পরিসংখ্যানে উল্লেখযোগ্য ওঠানামা নেই বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। তবে মামলার বাইরে অপহরণের ঘটনা রয়েছে কয়েক গুণ বেশি। বেশির ভাগই থানায় সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নথিভুক্ত।

পাল্টাচ্ছে ধরন: মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণের কৌশল অনেক পুরনো। পুলিশ ও গোয়েন্দারা জানান, অপরাধীরা মুক্তিপণের বাইরে নানা উদ্দেশ্যে এখন অপহরণ করছে বেশি। আর একই সঙ্গে অপহরণের কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে অপরাধীরা। নির্জন নয়, বরং জনবহুল এলাকাকে বেছে নিচ্ছে অপহরণকারীরা, যা প্রচলিত অপরাধ কৌশলের বিপরীত ও ঝুঁকিপূর্ণ। দিনদুপুরে প্রকাশ্যে অপহরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মত, ঘটনার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়াতেই এ কৌশল। অন্যদিকে র‌্যাব-পুলিশের পোশাকে ও পরিচয়ে অপহরণ বিষয়ে অনেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টার্গেট করা ব্যক্তিকে অপহরণের মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিলে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা কমে যায়। সে ক্ষেত্রে অপহরণকাজটা হয়ে যায় সহজ। আর তাই অপহরণকারীরা এ ধরনের পরিচয় দিয়ে থাকে। একই সঙ্গে অপহরণের মোটিভ ও অপরাধী নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতেও এ ধরনের চেষ্টা চালানো হয়ে থাকতে পারে।

রহস্যময় নীরবতা: সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত অপহরণসংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অপহৃত ব্যক্তি ফিরে আসার পরও অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে ঘটনাগুলোর রহস্য থেকে যাচ্ছে আড়ালেই। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করলেও অপহৃত ফেরার পর এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য দিচ্ছে না অনেকে। এমনকি বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য দেওয়ায় অপরাধী সম্পর্কে কোনো ধারণা মিলছে না।

আতঙ্ক চারদিকে: রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অপহরণের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আর তা নিয়েই বাড়ছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক।

সূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই