দেবতাদের অপহরণ কাণ্ড

অপহরণের মতো অন্যায় কর্ম মানুষ কবে প্রথম করেছে তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে এ ইতিহাস যে বহু প্রাচীন তা নিশ্চিত। দেবতা-অসুরদের অপহরণের গল্প তার দিকেই ইঙ্গিত করে। পারস্য, মিশরীয় কিংবা মেসোপটেমিয় পুরাণে অপহরণের কাহিনী নেই বললেই চলে। তবে গ্রীক ও ভারতীয় পুরাণে এ কাহিনী ভুরি ভুরি রয়েছে।

ইউরোপা : ফিনিশিয়ার রাজা এজিনরের একমাত্র মেয়ে ইউরোপা। অসামান্য রুপবতী ইউরোপাকে দেখলে সবাই রীতিমতো থ হয়ে তাকিয়ে থাকতো । একদিন ভোরে সখীদের নিয়ে বাগানে ফুল তুলতে গেলেন ইউরোপা। দেবরাজ জিউস এ সময় অলিম্পাসের প্রাসাদে বসেছিলেন। হঠাৎ ইউরোপার ওপরে তার নজর পড়ে । ইউরোপার সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেলেন জিউস। প্রেমে পাগলপারা দেবরাজ ইউরোপাকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য তিনি ধবধবে সাদা একটা ষাঁড়ের রূপ ধারণ করলেন। তারপর এসে নামলেন সাগরপাড়ের সেই ফুলবাগানে, যেখানে ইউরোপা তার বান্ধবীদের নিয়ে ফুল তুলছিল। ষাঁড়টিকে দেখে ইউরোপা আর তার বান্ধবীরা তো রীতিমত অবাক! এত সুন্দর ষাড় হতে পারে তা তাদের ধারণারও বাইরে ছিল। সবাই মিলে তারা ষাঁড়টিকে ঘিরে ধরলো।

এক পর্যায়ে ইউরোপা তার তৈরি করা ফুলের মালা জড়িয়ে দিলো ষাঁড়ের গলায় আর শিঙে। আদর পেয়ে ষাড়টি ইউরোপার সামনে তার দুই পা মুড়ে পিঠ নিচু করে দাঁড়ালো। আনন্দে লাফ দিয়ে ষাঁড়ের পিঠে উঠে পড়লো ইউরোপা। এরপরই পিঠ সোজা করে ষাড়রূপী জিউস তীর বেগে ছুটলেন সাগরের দিকে।

সাগরের অতল দিয়ে ষাঁড়টি যখন ছুট দিচ্ছিল, ইউরোপা তখন বুঝলেন তিনি দেবতার খপ্পড়ে পড়েছেন। তাকে নিয়ে জিউস সোজা চলে এলেন ক্রিট দ্বীপে। ইউরোপাকে প্রেম নিবেদন করলে জিউস। এখানেই ইউরোপার গর্ভে জিউসের তিন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এদের মধ্যে মিনোস পরে ক্রীট দ্বীপের রাজা হয়েছিলেন এবং বিখ্যাত মিনোয়ান বংশের সূচনা করেছিলেন।

পার্সিফোন : পাতাল দেবতা হেডেজ হলেন দেবরাজ জিউসের ভাই। ফসল বা নিসর্গের দেবী দিমিতারের কন্যা হলো বসন্তের দেবী পার্সিফোন। একদিন পার্সিফোনকে দেখে হেডেজ তার প্রেমে পড়ে যান। প্রেমের গোপন কথাটি জিউসকে জানিয়ে তার সাহায্য কামনা করেন হেডেজ। দুই ভাই মিলে পার্সিফোনকে ধরার জন্য একটি পরিকল্পনা করেন। জিউস ধরিত্রী দেবী গায়াকে নির্দেশ দিলেন মাঠে হলুদ ড্যাফোডিল ফুল ফোটাতে। একদিন সকালে দিমিতার মেয়েকে নিয়ে মাঠে অবতরণ করেন। সেখানে তিনি সাগর, নদী ও ঝর্ণার পরীদের সাথে পার্সিফোনকে ছেড়ে দিয়ে তার বিশাল শস্যক্ষেত্র দেখতে বের হলেন।

সাথীদের নিয়ে খেলায় ব্যস্ত পার্সিফোনের হঠাৎ করে চোখ গেলো মাঠে ফোটা সুন্দর ড্যাফোডিল ফুলের দিকে। পার্সিফোন নাচতে নাচতে একাই গেল ফুলের কাছে। ধরিত্রী দেবী গায়ার বুক থেকে তুলে নিতে চেষ্টা করলো ফুলের গুচ্ছকে। উপড়ানো ড্যাফোডিলের গুচ্ছ হাতে নেওয়া মাত্রই সেখানে গর্ত তৈরি হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সেই গর্ত বিশাল আকার ধারণ করে পার্সিফোনকে গ্রাস করে নিল। প্রচ-বেগে সেই গর্ত দিয়ে পার্সিফোন পৌঁছে গেল পাতালপুরীতে।

এদিকে দিমিতার ফিরে এস পার্সিফোনকে কোথাও খুঁজে পেলেন না। মেয়েকে না পেয়ে প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেলেন তিনি। পার্সিফোন না থাকায় পৃথিবী থেকে বষন্ত ঋতুও বিদায় নিয়েছে। ফসল উৎপাদিত না হওয়ায় পৃথিবীতে খাদ্য সংকট দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত দিমিতির খোঁজ পেলেন হেডেজই তার মেয়েকে অপহরণ করেছে। এরপরই তিনি সাহায্যের জন্য ছুটলেন দেবরাজ জিউসের কাছে। জিউস হার্মিসকে নির্দেশ দিলেন দিমিতিরকে দ্রুত পাতাললোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হেডেজ পার্সিফোনকে ফিরিয়ে দিলেন।

তবে পাতালের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ যদি পাতালপুরীর কোনো খাবার খায় তাহলে তাকে পাতাললোকেই ফিরে আসতে হবে। হেডেজ কৌশলে পার্সিফোনকে ডালিমের ছয়টি দানা খাইয়ে দিয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো বছরের ছয় মাস পার্সিফোন পাতালে থাকবে আর ছয় মাস থাকবে তার মায়ের কাছে। তখন থেকে বছরের যেই ছয় মাস পার্সিফোন পাতাললোকে থাকে তখন পৃথিবীতে চলে শীত ঋতু । আর যেই ছয় মাস সে পৃথিবীতে মায়ের সঙ্গে অবস্থান করে ততোদিন থাকে বসন্তকাল।

এয়স : টাইটানদের ঊষার দেবী ছিলেন এয়স। রোমান পুরাণে তিনি অরোরা নামে পরিচিত। এয়স ছিলেন টাইটান হাইপেরিয়ান ও থেইয়ার সন্তান। টাইটান দেবতা আস্ত্রাইয়ুসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তবে দেবী এয়স ছিলে ব্যভিচারী। অনেক মর্ত্য-মানবের সঙ্গেই তিনি গোপন অভিসার করেছেন । ওরিয়ন নামে এক দানবকেও ভালবাসতেন তিনি। এয়স মর্ত্য-মানব টিথোনাসকে পৃথিবী থেকে অপহরণ করে অলিম্পাসে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার অনুরোধে জিউস টিথোনাসকে অমরত্ব দান করেন। কিন্তু টিথোনাসের চিরযৌবন চাইতে ভুলে যান এয়স। ফলে টিথোনাস ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যেতে থাকেন। পরে দেবতারা তাকে পাখাযুক্ত পতঙ্গে রূপান্তরিত করেন। টিথোনাসের ঔরসে এয়সের গর্ভে দুই সন্তানের জন্ম হয়েছিল।

হিন্দু পুরাণে অপহরণ
তারা : নক্ষত্ররাজ্যের দেবী তারা দেবতা বৃহস্পতির স্ত্রী। আর বৃহস্পতি দেবতাদের পুরোহিত। একদিন তারাকে দেখে সোম অর্থাৎ চন্দ্র প্রেমে পড়ে যান। তিনি তারাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নিজের প্রাসাদে আটকে রাখেন। বৃহস্পতির শত অনুরোধেও তারাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন না সোম । এমনকি ব্রহ্মার অনুরোধও প্রত্যাখান করেন তিনি।

শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতির আহ্বানে সমস্ত দেবতারা সোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সোমের পক্ষে লড়াই করে অসুররা। যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে ব্রহ্মা ফের ছুটে আসেন সোমের কাছে। এবার সোম ব্রহ্মার প্রস্তাবে রাজি হয়ে তারাকে মুক্ত করে দেন। বৃহস্পতির কাছে তারা ফিরে আসেন । কিন্তু বাড়ি ফেরার পরই টের পাওয়া যায় তারা অন্তঃসত্ত্বা। এই সন্তানের পিতা কে জানতে চান বৃহস্পতি। কিন্তু তারা কিছুতেই তার জবাব দেন না। বৃহস্পতি তখন বলেন, যতক্ষণ পুত্রসন্তান জন্মলাভ না করছে তারাকে তিনি গ্রহণ করবেন না। এ-কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারার গর্ভের পুত্র জন্মগ্রহণ করে। ফুটফুটে শিশু সন্তানকে দেখে সোম ও বৃহস্পতি উভয়েই তাকে নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। আবারও দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ সময় শিশুটি রেগে গিয়ে উভয়কে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা আবার আসেন বৃহস্পতি-সোমের কাছে। তিনি তারার কাছে জানতে চান এই শিশুর পিতা কে- বৃহস্পতি না সোম? তখন তারা জানান, সোম। সোম সানন্দে পুত্রকে গ্রহণ করেন এবং তার নাম রাখেন বুধ।

অর্জুন-উত্তরা : কৌরবদের কাছে পাশায় হেরে যাওয়ায় পা-বদের জন্য ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস নির্ধারণ করা হয়। অজ্ঞাতবাসের সময়ে গান্ডিবধারী অর্জুন নারীরূপী বৃহন্নলার ছদ্মবেশে চাকরি নিয়েছিলেন বিরাট রাজার অন্তঃপুরে। সেখানে রাজা বিরাটের কন্যা উত্তরাকে নাচ-গান শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে উত্তরাকে অপহরণ করে নিজপুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন অর্জুন।

নরকাসুর : হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী নরকাসুর ছিলেন অসুর। তিনি ছিলেন পৃথিবীর পুত্র। এ ছাড়া সে ছিল দেবতাদের পরম শত্রু। নরকাসুর একবার হাতির রূপ ধরে বিশ্বকর্মার কন্যাকে অপহরণ করেন। পরে ইনি গন্ধর্ব, মানুষ ও দেবকন্যা ও অপ্সরাদের অপহরণ করে তার রাজ্যের রাজধানী প্রাগজ্যোতিষে বন্দী করে রাখেন। অপহৃতদের মোট সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার।

একবার নরকাসুর ইন্দ্রজননী অদিতির কু-ল চুরি করে প্রাগজ্যোতিষের একটি দুর্গে রেখে আসেন। কৃষ্ণের কাছে ইন্দ্র অভিযোগ করলে তিনি নরকাসুরকে হত্যা করে ওই কু-ল উদ্ধার করেন। পরে নরকাসুর যেসব নারীকে অপহরণের পর বন্দী করে রেখেছিলেন কৃষ্ণ তাঁদের বিয়ে করেন।



মন্তব্য চালু নেই