দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে সংসদ ভবন

বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের নান্দনিক স্থাপত্যগুলোর মধ্যে জাতীয় সংসদ ভবন অন্যতম। এই ভবনটি দেখতে প্রতিদিনই বহু পর্যটক আসেন। বিকেলে ঘুরতে যায় শত শত মানুষ। কিন্তু শিগগিরই এতোগুলো মানুষের দৃষ্টি আড়ালে চলে যাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন এ ভবন। উঁচু কংক্রিটের দেয়ালে ঘেরা হবে চারপাশ। উপরে থাকবে মোটা লোহার শলাকা। অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আদলে তৈরি করা হবে এ প্রাচীর।

সংসদ সচিবালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সৌন্দর্য্য পিপাসুদের বিরোধিতা থাকলেও নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই শুরু করা হবে নির্মাণ কাজ।

এ ব্যাপারে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী  জানান, বিষয়টি একরকম চূড়ান্ত হয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে দেখানোর পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাজ শুরু করা হবে।

স্পিকার আরো জানান, প্রাচীরের উচ্চতা হবে আট ফুট। যার মধ্যে নিচের দুই ফুট ইট, বালু, সিমেন্টের তৈরি পাকা দেয়াল আর বাকি ছয় ফুট লোহার প্রাচীর। লোহার প্রাচীর ঢেকে দেয়া হবে বিভিন্ন লতা জাতীয় গুল্ম দিয়ে।

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, পৃথিবীর অনন্য সুন্দর এ স্থাপত্যশিল্পের চারপাশে আড়াই মাইলজুড়ে নির্মাণ করা হবে এ বেষ্টনী। জি কে বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের কাজ করছে।

২০১৩ সালে শুরুর পর ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে এর কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি স্থাপত্যবিদ, পরিবেশবিদ ও সৌন্দর্য্য পিপাসুদের চরম বিরোধিতার এক পর্যায়ে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। তৈরি করা হয় নতুন নকশা। যেটি এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায়।

তবে কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত স্থাপত্যবিদরা। তাদের মতে, সরকারের এ সিদ্ধান্ত দর্শনার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে। পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই ইসাদোর কানের দৃষ্টিনন্দন নকশায় আঘাত হানবে।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন  বলেন, ‘নির্মাণশৈলীর কারণে এই ভবনের ছবি স্থাপত্যবিদ্যার ইতিহাসের বইয়ের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থায় (ইউনেসকো) প্রতিষ্ঠানটি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। এই অবস্থায় ভবনের মূল নকশা উপেক্ষা করে এ ধরনের বেষ্টনী তৈরি আত্মঘাতি হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সংসদ ভবন জনগণের কাছ থেকে আলাদা করা হচ্ছে। প্রাচীর দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। নিরাপত্তার জন্য কর্মীবাহিনী বাড়ান, সিসি টিভি বসানো যেতে পারে।’
সরকারের এ সিদ্ধান্ত হাইকোর্টের রায়ের পরিপন্থি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বিশ্ব তথ্যকোষ ইউকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০০ একর এলাকায় নির্মিত এই স্থাপনার স্থাপত্য দর্শনের মূলে ছিল স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্থাপত্যশৈলী দ্বারা। চার দশকে যা ক্রমেই বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে হয়ে ওঠে দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে।

লুই ইসাদোর কানের নকশায় নয়টি ব্লকে নির্মিত মূল ভবন ঘিরে রয়েছে একটি কৃত্রিম হ্রদ ও দুটি বাগান। মাঝখানে ১৫৫ ফুট উচ্চতার অষ্টভূজ ব্লক, অন্য আটটি ব্লক ১১০ ফুট। করিডোর, লিফট, সিঁড়ি ও বৃত্তাকার পথ দিয়ে আনুভূমিক ও উল্লম্বভাবে ব্লকগুলো এমনভাবে আন্তঃসংযোগ করা হয়েছে যে নয়টি ব্লক মিলে এই ভবনটি অভিন্ন স্থান হিসেবে ব্যবহার করা যায়।parliament02

চতুর্থ তলা আরেকটা জগত! এমনভাবে নির্মিত যেন এটাই বাগান, তার পাশ দিয়ে কয়েকটি ছয় তলা ভবন উঠে গেছে। ভেতরের দেয়ালগুলোও বাইরের মতোই। কোথাও বিশাল গোল ফোঁকর আবার কোথাও সুদৃশ্য জ্যামিতিক কাঠামো।

দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনায় এক সময়ে অবাধে যাতায়াতের সুযোগ ছিল দর্শনার্থীদের। পরে তা সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেখানেও জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়।

জানা যায়, মহাজোট সরকারের এর আগের সময়কালে চারপাশে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে লোহার বেষ্টনী উঁচু করা প্রকল্প গ্রহণ করে গণপূর্ত বিভাগ। বর্তমানে ভবনের চারপাশে তিন ফুট উঁচু লোহার বেষ্টনী রয়েছে।

এর আগে ভবনের ভেতরে কাচ ও কাঠের বিভাজন দিয়ে ‘অসংখ্য’ কক্ষ তৈরি করা হয়। নকশা অমান্য করে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাড়ি বানানো হয়।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ ভবন বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শন। এর স্থাপত্যমান অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। মূল নকশার বাইরে কোনো ধরনের পরিবর্তন করা যাবে না।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কতোটুকু রক্ষিত সেটাই দেখার বিষয়।



মন্তব্য চালু নেই