‘দু’দলে ঐক্য না হলে সংকটের সমাধান সম্ভব নয়’

বাংলাদেশের বর্তমান সংকট আসলে রাজনৈতিক। আর দুটি বড় দলের মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্য না হলে রাজনৈতিকভাবে এ সংকটের সমাধান করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহফুজ উল্লাহ।

রেডিও তেহরানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি গুলশানের ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নির্মম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, যারা এরসঙ্গে জড়িত তারা ওখানে শুধু বিদেশিদের হত্যা করবে এমন কথা বলেছে কিন্তু এরমধ্যে তিনজন বাংলাদেশি মারা গেছে। সেই তিনজন কেন মারা গেল সে বিষয়ে বিভিন্ন রকমের কাহিনী বের হচ্ছে।

মাহফুজ উল্লাহ বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে এতদিন বলা হচ্ছিল- উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের চর্চা হয় মাদ্রাসাগুলোতে এটি অপপ্রচার ছিল।

প্রশ্ন: বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এখন সবচেয়ে যে বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছে তাহলো সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা। এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর সঙ্গে মুসলমানদের নামটিই উচ্চারিত হচ্ছে বেশি। এসবের মূল কারণ কী এবং বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক এই সংকটে জড়িয়ে গেল কিনা?

মাহফুজ উল্লাহ: দেখুন, আপনি কিভাবে সন্ত্রাস এবং চরমপন্থাকে সংজ্ঞায়িত করেন তার ওপর নির্ভর করবে এর মূল কারণ নির্ধারণের বিষয়টি। কারণ হচ্ছে বিগত শতকে যখন পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের বিরোধ ছিল তখন যেসব তরুণ পুঁজিবাদে বিশ্বাস করতেন না তারা সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুকে যেতেন। কারণ তরুণদের বেঁচে থাকার জন্য বেড়ে ওঠার জন্য একটা আদর্শ বা বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়।

তবে সমাজতন্ত্র যখন পিছুহটা শুরু করল তখন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তরুণদের আদর্শ বলতে আর কিছু থাকল না তখন ধর্মবিশ্বাস এবং ইসলাম তাদের সামনে একটি আদর্শ হিসেবে উপস্থিত হয়। আর ইসলামের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিভিন্ন বিষয়ে যেমনটি অন্যান্য আদর্শের ক্ষেত্রেও আছে। আমরা যদি পেছন দিকে তাকিয়ে স্যামুয়েল হান্টিংটনের কথা মনে করি তাহলে দেখব তিনি বলেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীতে খৃষ্টান ও মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে সংঘর্ষ বা সংকট দেখা দেবে। আর সেটারও একটা বহিঃপ্রকাশ এটি হতে পারে।

আর বাংলাদেশেও তো তার ঢেউ লাগতেই পারে। কারণ বাংলাদেশ তো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো রাষ্ট্র নয়। এখন ইন্টারনেটের যুগে বাংলাদেশের তরুণরা পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে ঘটছে তার খোঁজ খবর নিচ্ছে।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমাদের তরুণদের চিন্তা করার, সময় কাটাবার মতো কোনো কিছু নেই। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন থাকত, যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থাকত- তাহলে তরুণরা ওইসব কর্মকাণ্ডে অনেক বেশি জড়িত হতে পারত। আর তারা ওইসব কাজে জড়িত হলে হয়তো আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না, তাদের নিজেদেরকে নিয়ে ভাবতে হতো না।

এই মুহূর্তে তারা যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে এর কারণ তাদের সামনে যেহেতু খুব বড় একটা শূন্যতা আছে-এরমধ্যে আছে বিশ্বাস বা দর্শনের অভাব, আত্মপরিচয়ের সংকট আছে, তাদের সময় কাটানোর একটা বিষয় আছে এখানে তাদের সাংস্কৃতিক একটা শূন্যতাও আছে। কারণ তরুণদের যে বয়স সেই বয়সটা স্বক্রিয় হওয়ার একটা বয়স এই বয়সটি আসলে কর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একটি বয়স। তো সেই বয়সে এসব সংকট ও সমস্যার কারণে তারা এভাবে চলে যাচ্ছে। তাদের শূন্যস্থানটাকে পূরণ করার জন্য তাদের সামনে ইসলামকে একটু ভিন্নধরণের ব্যাখ্যা দিয়ে উপস্থাপন করা হয় তখন তারা এর প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমি যদি মনে করি ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা সম্বলিত দর্শনটি তরুণদের বিভ্রান্ত করছে তাহলে তাদের সামনে এর সুষ্ঠু ব্যাখ্যাটা তুলে ধরতে হবে অথবা পাল্টা একটা দর্শন বা একটি আদর্শ তাদের সামনে দিতে হবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে পবিত্র রমজান মাসে ঘটে গেল অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা এবং বহু প্রাণ ঝরে গেল। কীভাবে দেখছেন ঘটনাটিকে? পেছনের কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?

মাহফুজ উল্লাহ: দেখুন গুলশানের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নির্মম একটি ঘটনা। ওই ঘটনা আমাদের সকলের মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু যারা এরসঙ্গে জড়িত তাদের কাজের মধ্যে দেখবেন যে একটা বিষয় আছে। তারা ওখানে শুধু বিদেশিদের হত্যা করবে এমন কথা তারা বলেছে। তবে এরমধ্যে তিনজন বাংলাদেশি মারা গেছে। তো সেই তিনজন কেন মারা গেল সে বিষয়ে বিভিন্ন রকমের কাহিনী বের হচ্ছে। এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো কিছু বলা সম্ভব না।

এখানে আমার যেটা ধারণা হয়তো তাদেরকে বলা হয়েছে এই রমজান মাসের সাথে পবিত্রতার একটি বিষয় আছে। এই মাসের যাবতীয় কর্মের সাথে একটি সুফল পাওয়ার বিষয় আছে। কাজেই তাদেরকে যেভাবে মোটিভেট করা হয়েছে সেই মোটিভেশন থেকে তারা এই কাজটি করেছে।

এখানে একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে বিষয়টি আমরা অনেকেই বিবেচনায় নেই না সেটা হচ্ছে- যে যেভাবেই হোক তরুণদেরকে যে মোটিভেট করে তার যে শক্তি ; সেই শক্তির কথা কিন্তু আমরা চিন্তাই করি না। কারণ এমনভাবে তাদেরকে মোটিভেট করা হয় যে সে সবকিছু ভুলে যায়। একটা তরুণের জীবনে ভালোবাসা আছে, স্বপ্ন আছে, প্রেম আছে, আছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন এর সবকিছুই সে ভুলে গিয়ে ওই দিকে সে ধাবিত হয়। কাজেই যিনি বা যারা তরুণদেরকে মোটিভেশন করেন তাদের শক্তিটাকেও কিন্তু আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে। সেটাকে যদি আমরা বিবেচনায় না নেই তাহলে বিষয়টিকে ঠিক যেভাবে ধরবার সেভাবে ধরতে পারব না। একধরণের ডিনায়েলের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আমাদের সরকারিভাবে বলা হয় যে এসব জিনিষের কোনো অস্তিত্ব আমাদের দেশে নেই। কিন্তু গুলশানের ঘটনায় সেটা প্রমাণ করে দিল এটা প্রবলভাবে বাংলাদেশে উপস্থিত। আর আমরা যদি সঠিকভাবে এটার মোকাবেলা করতে না পারি ভবিষ্যতে আরো এ ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়!

প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মহল থেকে এতদিন বলা হচ্ছিল- উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের চর্চা হয় মাদ্রাসাগুলোতে। কিন্তু গুলশানের ঘটনায় দেখা গেল এসবের সঙ্গে জড়িতরা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের এবং ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করা তরুণ। প্রশ্ন হচ্ছে- মাদ্রাসাগুলো নিয়ে কী তাহলে অপপ্রচার ছিল নাকি সন্ত্রাসবাদ তথা জঙ্গিবাদের প্রবণতা ও ধরন বদলে গেল?

মাহফুজ উল্লাহ: নিঃসন্দেহে দেশের মাদ্রাসগুলো নিয়ে অপপ্রচার ছিল বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি। কারণ একসময় অভিযোগ করা হতো যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মাদ্রাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা প্রচুর যুবক ঢুকে পড়েছে। এগুলোর সবই আসলে কথার কথা। দায়িত্বপূর্ণ পদে বা আসনে থেকে যারা এসব কথা বলেন তথ্যভিত্তিক নয় এমন সব মন্তব্য করেন। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সব মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা করে এভাবে দেখাটা ঠিক না। কারণ আমি ওই যে বল্লাম আপনি আদর্শটাকে কিভাবে দেখেন তার ওপরে নির্ভর করে। যে আদর্শের কারণে সন্ত্রাস হচ্ছে তার সাথে মাদ্রাসা বা অমাদ্রাসার কোনো সম্পর্ক নেই।

মাদ্রাসার শিক্ষাটা একধরণের এককেন্দ্রীক এবং বলা চলে তারা একধরণের বন্দি গন্ডির মধ্যে থাকেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের জগৎটা অনেক সম্প্রসারিত। কাজেই তাদের পক্ষে এইসব দিকে যাওয়াটা অতি সহজ হয়। আর এই সন্ত্রাসকে একটি নির্দিষ্ট কোনো কারণ দিয়ে চিহ্নিত করা খুব কঠিন।

প্রশ্ন: গুলশানের ঘটনার পর মানুষের মধ্যে যে প্রশ্ন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তাহলো- কারা এর পেছনে রয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে আপনি কী বলবেন?

মাহফুজ উল্লাহ: দেখুন আপনার এই প্রশ্নের ব্যাপারে আমি সুর্নিদিষ্টভাবে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। কারণ এখানে তদন্তের বিষয় আছে। আর বিষয়টি নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে যার কোনো জবাব আমরা পাইনি। কারণ অতীতেও আমরা দেখেছি কোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই সাইট ইন্টেলিজেন্সের যে ওয়েব সাইট আছে সেখানে ১৫ মিনিট, বিশ মিনিট বা আধাঘন্টার মধ্যে ঘটনাটা আপলোডেড হয়। এটা কি করে হয়! বাংলাদেশে একটা ঘটনা ঘটার আধাঘন্টার মধ্যে অন্য একটা ওয়েবসাইটে আপলোডেড হয়ে যাওয়া কিভাবে সম্ভব! তারমানে হচ্ছে তথ্যটা এখান থেকেই যায় এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর এখান থেকে না গেলে তো ওদের পক্ষে এটা আপলোড করা সম্ভব না। তারমানে এখানেও একধরণের কোলাবোরেশন আছে। সেই কোলাবোরেশনটা সাংগঠনিক না ব্যক্তি পর্যায় সেটা বলা একটু কঠিন। কিন্তু যোগাযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

প্রশ্ন: দেশে যে উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ চলছে এর অবসানে আসলে করণীয় কী? সেটি সরকারের দিক দিয়ে এবং জনগণের দিক থেকে….।

মাহফুজ উল্লাহ: দেখুন করণীয় একটাই- সেটা হচ্ছে আমরা যদি এটাকে প্রশাসনিক সমস্যা বলে মনে করি তাহলে ভুল হবে। প্রশাসনিকভাবে এটাকে মোকাবেলা করতে হবে। তবে আমার কাছে এটা খুব পরিষ্কার যে এটা রাজনৈতিক সমস্যা। আর রাজনৈতিক সমস্যাকে সমাধান করতে হলে দেশে যে বড় দুটি রাজনৈতিক ধারা আছে তার মধ্যে একধরনের আপোশ হতে হবে। তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হবে। কারণ তারা বলছে যে সমাজে একতা আনতে হবে। কারণ বাংলাদেশের সমাজ একেবারেই রাজনীতির আবর্তে দ্বিধাবিভক্ত।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে বর্তমান সরকার যেহেতু পুরোপুরি নির্বাচিত সরকার নয়, বর্তমান সরকারের সাথে দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোনোরকমভাবে অ্যাটাচ ফিল করে না। আর এই বিচ্ছিন্নবোধ থেকেই সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থনও দেয় না। কাজেই দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে যদি সমঝোতা না হয় তাহলে এই সংকটকে আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারব না।



মন্তব্য চালু নেই