দুজনই ছোটবেলায় ছিলেন একে অপরের ছেলে বন্ধু, এখন তারা স্বামী-স্ত্রী!

ছোটবেলায় দুজনই ছিলেন ছেলে সহপাঠী, এখন তারা স্বামী-স্ত্রী।একজন অস্ত্রপচারের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়ে মেয়ে হলেন। দুজনে বিয়েও করলেন। ছেলেবেলায় তার নাম অন্য থাকলেও রূপান্তরিত হওয়ার পর ‘শ্রী’ হল তার পরিচয়। আর স্বামী সঞ্জয় ।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হইহুল্লোড় করে, সানাই-টানাই বাজিয়ে, যাবতীয় আচার পালন করে, আত্মীয়স্বজন নেমন্তন্ন করে মহাধুমধামে বিয়ে সম্পন্ন হয় । এখন দিব্যি সুখের সংসার তাদের।

কলকাতার সল্টলেক বৈশাখীর সরকারি আবাসনে বড় হয়েছেন শ্রী। বাড়ির বড় ছেলে। বাবা সরকারি চাকুরে। বাড়িতে বাবা-মা-ছোট বোন আর প্রায় সমবয়সী ছোট কাকা। রূপান্তরকামীদের অস্তিত্ব ও জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন শ্রী নিজেও।

শরীরটা ছেলের হলেও একটু বড় হওয়ার পর থেকে শ্রী আপনা থেকেই নিজেকে মেয়ে বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। আবাসনে মেয়েরাই ছিল তার বন্ধু। চারপাশের মানুষের চোখে সেটা ধরাও পড়েছিল। তখন ক্লাস ফোর-ফাইভ। তার মেয়েলি স্বভাব আর হাবভাব নিয়ে সমস্যা শুরু হল বাড়িতে-স্কুলেও। মস্করা, আলোচনা, মন্তব্য— ক্রমশ নিজের ভিতরেই একটা বদ্ধ কুঠুরিতে আটকে যাচ্ছিল শ্রীয়ের সত্ত্বা।

শ্রীর মা পূর্ণিমাদেবী বললেন, ‘ও যখন ফোর-ফাইভে পড়ে, ও যে অন্যরকম সেটা বুঝতে শুরু করলাম। আমার স্বামীও সব বুঝতেন। চুপ করে থাকতেন। আত্মীয়দের নিয়ে সমস্যা হত। একটা সময় পর সমস্ত পারিবারিক উৎসব, অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। তবে শ্রী-র বিয়েতে সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছি। বেশিরভাগই এসেছেন এবং কোনও সমস্যা তৈরি করেননি।’

শ্রীর কথায়- তার মা এবং সঞ্জয় এই দু’জন না থাকলে কবে, কোথায় ভেসে যেতেন। ক্লাস এইটে নানা ঝামেলায় স্কুল বদল হল। তখন বয়ঃসন্ধি শুরু। শারীরিক-মানসিক-পারিপার্শ্বিক টানাপড়েনে শ্রী দিশেহারা, একা। নতুন স্কুলে এসে ভাগ্যক্রমে সহানুভূতিশীল কিছু স্যার পেলেন, পেলেন দুই বন্ধুকে। তাদের এক জন ক্লাসের ফার্স্ট বয় আর অন্য জন এই সঞ্জয়।

ভালবাসা হাতড়ে বেড়ানো শ্রী মনে-মনে ফার্স্ট বয়টির প্রেমে পড়লেন এবং একটা সময়ে ধাক্কা খেলেন। সেই সময় হাতটা শক্ত করে ধরলেন সঞ্জয়। তখন কোনও প্রেমটেম ছিল না। ক্রমশ অনেকগুলো বছর পাশাপাশি অনেক চড়াই-উতরাই কাটিয়ে কখন যেন বন্ধুত্ব, মায়া-মমতা-সহানুভূতি-প্রেম সব একাকার হয়ে গেল। দু’জনে দু’জনকে পড়তে পারলেন স্পষ্টভাবে। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। কঠিন সিদ্ধান্ত। এটা বছর আড়াই আগের কথা।

এরপর শারীরিক ভাবে মেয়েতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেন শ্রী। পুরো খরচটাই দিলেন সঞ্জয়।

‘অসম্ভব কঠিন একটা প্রক্রিয়া। যেমন শরীরে যন্ত্রণা হয় তেমনই মানসিক ভাবে ছিন্নভিন্ন হতে হয়। বাড়ির সাপোর্টটা এইসময় ভীষণ-ভীষণ দরকার। আমাকে ক্রমাগত মা আর সঞ্জয় সামলে গিয়েছে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় একটা সময় থেকে মেয়েদের পোশাকে বাইরে বেরোনো শুরু করতে হয়। তখন মারাত্মক টিটকিরির মুখে পড়তাম। বেরোতে চাইতাম না। মা তখন আমাকে সাহস দিয়ে বলতেন, খুব সমস্যা হলে আমি যেন মা-কে ফোন করি। মা গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে আনবে।’— মুখ নিচু করে বলছিলেন শ্রী।

অপারেশনের পরে সবচেয়ে বড় টেনশন ছিল হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নিয়ে। প্রথমে নেগেটিভ ছিল সবকিছু। কিন্তু অনড় ছিলেন সঞ্জয়। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে মারাত্মক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন আত্মীয়-বন্ধুরা। নড়াতে পারেননি।

সঞ্জয় বলেন, ‘আমি বাড়ির বড় ছেলে। আমার ক্লাসের বন্ধু হিসাবে শ্রী-কেও আমার বাড়িতে সবাই ছোটবেলা থেকে দেখেছেন প্যান্ট-শার্ট পরা একটা ছেলে হিসাবে। হঠাৎ করে আপনার বাড়ির ছেলে যদি বলে যে, সে তার এক পুরুষ বন্ধুকে সামাজিক ভাবে বৌ করে আনতে চায় তা হলে আপনি কি প্রথমে সহজভাবে নেবেন? ’

সঞ্জয় বলেন, ‘রূপান্তর ব্যাপারটা হজম করতে এই প্রজন্মেরই অসুবিধা হয়, আমার বাবা-মা তো আগের প্রজন্মের মানুষ। বরং আমি অনেক ভাগ্যবান যে, আমার বাড়িতে শেষপর্যন্ত সবাই শ্রী-কে বুকে টেনে নিয়েছেন। আমার প্রত্যাশার থেকে বেশি স্নেহ আর সন্মান দিয়েছেন।’

জীবন যে তার জন্য এত আনন্দ লুকিয়ে রেখেছিল, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় শ্রী-র।
অন্যদিকে জামাইকে নিয়ে একইরকম আপ্লুত শ্রী-র মা-বাবা। ‘কপাল করে এমন ছেলে পেয়েছি। কী ভাবে আমাদের ভাল রাখবে সবসময় সেই চিন্তা। রোজ খোঁজ নেবে, দেখা করে যাবে। শ্রী-কে এত যত্ন করে যা আমরাও করিনি।’

কলকাতার প্রান্তে ব্যতিক্রম এই একজোড়া জীবন চারপাশের পরিবেশে মিলে-মিশে আপাতত শ্রীময় দিন কাটাচ্ছে ।

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা



মন্তব্য চালু নেই