দুঃখিত স্যার, আমিই বাংলাদেশ

কবীর চৌধুরী তন্ময় : যায় যাবে প্রাণ তাহে, প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহেনশাহে-কাজী কাদের নেওয়াজ শিক্ষকের যে মর্যাদার কথা বলেছিল, যেভাবে শিক্ষকের সম্মানের দৃঢ়তার কথা বলেছিল তা আজ অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ!

কখনো শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, কখনো শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের নকল দেওয়ার গল্প, কখনো টাকার কাছে শিক্ষকের মর্যাদা বিক্রি, কখনো রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে পক্ষ-পাত তুষ্ট করা আবার কখনো পেশী শক্তির ভয়ে নিজের জীবন রক্ষার্থে মাথা নত করা ইত্যাদি ইত্যাদি…।

নারায়ণগঞ্জে সাংসদ সেলিম ওসমানের হাতের আঙ্গুলের নির্দেশে প্রাণের ভয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তিও কান ধরে উঠ-বস করে সেই মর্যাদা শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি।

এই পেশী শক্তির ব্যবহার বা হত্যার ভয় আজ সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের রন্দ্রে রন্দ্রে অপশক্তি নিজেদের প্রভাব বিস্তার ঘটিয়ে সভ্যতা, মানবতাবোধ এবং মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান-শ্রদ্ধা ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র করছে প্রতিনিয়ত।

রাষ্ট্রকে বিতর্কিত বা রাষ্ট্রের ভাবমুর্তি নষ্ট করার জন্য কখনো লেখক-ব্লগার হত্যা করে চলেছে। আবার কখনো ঈমাম, পুরোহিত, শিক্ষকসহ বিদেশী নাগরিকদের হত্যার মাধ্যমে নিজেদের নীলনকশার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ণের পথে এ ভয় অব্যাহত রাখেছে।

শিক্ষক শ্যামল কান্তির অপরাধ স্কুল পরিচালনা পর্ষদের অনেকের নাচের পুতুল বা পকেটের লোক হতে পারেনি। শিক্ষালয় ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নষ্ট হোক এমন কোনো পদক্ষেপ তিঁনি গ্রহণ করেনি। পরিচালনা পর্ষদের অনেক ব্যক্তির বকা-ঝকা আর হুমকি-ধামকি’র পরও শিক্ষক হিসেবে তাঁর মর্যাদা ধরে রাখার জন্য প্রাণ-পণ চেষ্ঠা করেছে।

শিক্ষার্থীকে শিক্ষক শাসন করবে, বারণ করবে এমনকি বেত্রাঘাত করবে এটা আমাদের আদি সংস্কৃতির অংশ। আমাদের সময়ও শিক্ষক আমাদের বেত্রাঘাত করেছে। বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে এই শাসন-বারণ অনেকটাই বদলেছে। তারপরেও কিছু কিছু শিক্ষালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীর পাঠদানের বিষয়ে তাঁদের শাসন-বারণ অব্যাহত রেখেছে।

শ্যামল কান্তি শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে শাসণ-বারণ বা বেত্রাঘাত করাকে কেন্দ্র করে পাঁচ-পাঁচটি মসজিদের মাইকে ঘোষনা দিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে কটুক্তি ছড়িয়ে ইসলাম ধর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মানুভূতি মানুষদের ক্ষ্যাপিয়ে তুলেছে মুলত শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে হত্যা করার জন্য। কারণ, প্রকৃত শিক্ষকের মর্যাদা যেখানে বিপন্ন সেখানে শ্যামল কান্তি তাঁর আদি ঐতিহ্য সেই শিক্ষকের মর্যাদায় ছিলো অটল ও দৃঢ়চিত্তে বিলয়ান।

সাংসদ সেলিম ওসমান ব্যক্তি শ্যামল কান্তিকে কানে ধরে উঠ-বস করিয়ে অপমান-অপদস্থ করেনি; করেছে শিক্ষকের মর্যাদাকে, শিক্ষকের আত্মসম্মানকে, শিক্ষক সমাজকে, বাংলাদেশ গড়ার কারিগরদের! আর তার দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছে ইসলাম ধর্মের উপর। ব্যবহার করেছে ধর্মানুভূতি ও ইসলামের প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস-শ্রদ্ধাকে।

সেলিম ওসমান শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতা যখন সেলিম ওসমানের বিচারের কথা বলছে, তখন সে তার সাহস-দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে শেষ কাজটি করেছে লাঞ্ছিত শিক্ষককে বহিষ্কার করার মাধ্যমে।

যতটুকু মনে পড়ে, ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধী কামারুজ্জামানের সাতটি অপরাধের মধ্যে একটি জন্য তাকে দশ বছর কারাদন্ডের নির্দেশ দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর সেই অপরাধ- ১৯৭১ সালে মে মাসের দিকে শেরপুর কলেজ শিক্ষক আবদুল হান্নানের মুখে চুন-কালি মেখে সারা শহর ঘুরিয়ে অপমান-অপদস্থ করার মতন জঘন্যতম অপরাধ করেছে বলে।

চলতি বছরের সেই একই মাসের ১৩ তারিখে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠ-বস করিয়ে একই অপরাধ করেছে সাংসদ সেলিম ওসমানও। যার ভিডিও ও স্থির চিত্র এখন স্যোসাল মিডিয়া ভাইরাল হয়ে গণমাধ্যমেও ডকুমেন্ট আকারে খুজে পাওয়া যাবে।

ইতোমধ্যেই, শিক্ষা মন্ত্রনালয় ও মাউশি’র প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বরখাস্তের আদেশ অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে পরিচালনা পর্ষদ এজেন্ডাবহির্ভূতভাবে ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করায় স্কুল কমিটিও বালিত করেছে।

অন্যদিকে শিক্ষককে কান ধরিয়ে উঠ-বস করানোর ঘটনায় সাংসদ সেলিম ওসমানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বুধবার (১৮ মে) এই আদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

এদিকে ১৯ মে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সাংসদ সেলিম ওসমান বলেন, “যদি আমাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেন, আল্লাহকে যদি কেউ কটাক্ষ করে, একজন মুসলমান হিসেবে আমি কার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব? যথেষ্ট পরিমাণ ডকুমেন্টস আছে। ক্ষমাটা কার কাছে চাইতে বলছেন আমাকে? শিক্ষকের কাছে?

এটা আসলে একেবারেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এই ষড়যন্ত্রের সাথে যারা সম্পৃক্ত; তাদের আইনের আওতায় আনা এবং বিচারের মুখোমুখির সামনে এখন ধর্মীয় অনুভূতি বা ইসলাম ধর্মকে ঠায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

একটু সংকা, একটু সংশয় কাজ করে। যেখানে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা মাঝে মাঝে নিজেরাই বিচারের দাবি তোলে, বিচারের আকুতি জানায়; তখন দেশের সাধারণ জনগণ হয়ে আমিও ভাবি- আমি কার কাছে বিচারের দাবি জানাবো (?), যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকরাই বিচারের প্রার্থী! তারপরেও আশাকরছি, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আসল চক্রান্তকারীরা আইনের আওতায় আসবে এবং সেই সাথে শিক্ষকের মর্যাদাহানী ও অসম্মানকারীদের দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিত হবে যা ভবিষ্যত নাগরিকের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

আমি ও আমরা দেশের সাধারণ জনগণ শিক্ষক শ্যামল কান্তির সেই আত্মমর্যাদা কখনো ফিরিয়ে দিতে পারবো না তবে, সম্মানহানী ও ষড়যন্ত্রকারীদের দৃষ্টান্ত শাস্তির ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে সুন্দর ও সভ্যতার পক্ষে এগিয়ে যেতে পারি। একান্ত আপন হয়ে নিজগুণে এই অশ্রদ্ধা-বর্বরতার দ্বায় মাথায় নিয়ে নিজের কানে নিজে ধরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শুধু এইটুকুই বলতে পারি- দুঃখিত স্যার, আমিই বাংলাদেশ।

লেখক :

কবীর চৌধুরী তন্ময়
সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)
[email protected]


(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। আওয়ার নিউজ বিডি এবং আওয়ার নিউজ বিডি’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)



মন্তব্য চালু নেই