দক্ষিণ এশিয়ায় জমজমাট কিডনি ব্যবসা!

এখন থেকে তিন বছর আগেও স্কুল বাদ দেয়া বিকাশ তার বাবার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করে সহায়তা করত। উত্তর ভারতের কানপুরের বাসিন্দা বিকাশ তার বাবাকে সহায়তা করার এ কাজকে খুব তুচ্ছ কাজ হিসেবেই দেখত।

দিন বদলেছে, বদলেছে বিকাশের ভাগ্য। ২৬ বছর বয়সী এই যুবক কিডনি বিক্রির দালালি করে এখন প্রচুর টাকা আয় করেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কিডনি সরবারহ করেন দেন-দরবার করে, আর সে উপার্জিত টাকার পরিমানে বেশ সন্তুষ্টও বিকাশ।

নিজের মূল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিকাশ আল জাজিরাকে বলেন, আপনার যদি টাকা থাকে এবং খুব দ্রুত একটি কিডনির প্রয়োজন পড়ে। আমি আপনার জন্য একজন দাতা খুঁজে দিব এবং এক মাসের মধ্যেই আপনি নতুন কিডনি নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারবেন।’

বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দেহের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রথম কাতারেই রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। এরমধ্যে ভারত আবার বিশ্বের সবচে’ বেশি কিডনি রপ্তানীকারক। প্রতি বছর ভারতের দুই হাজার নাগরিক তাদের কিডনি বিক্রি করেন।

এমন সব তথ্য নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতার ভিত্তিক পত্রিকা আল জাজিরা। প্রতিবেদনে কিডনি ব্যবসা নিয়ে বিস্তর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মুম্বাই ভিত্তিক এজেন্ট আদর্শ বলেন, তার কাছ থেকে কানাডা, ইসরাইল, ব্রিটেন, সৌদি আরব, দুবাই এবং বাহরাইনের ক্রেতারা কিডনি কিনেন। তবে ভারতেও অনেক ক্রেতা আছে বলে জানান তিনি।

মূত্রাশয় সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বেড়েছে কিডনির সমস্যা, সেই সাথে বেড়েছে এর চাহিদাও। তবে দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সারা বিশ্বেই, কিছু সংস্কৃতিতে মরার পরেও দেহের অঙ্গ দানে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তবে কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকে কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিডনি দিতে চান সেটা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব।

কিডনির চাহিদা এবং আইনি নিষেধাজ্ঞার এই ফাঁকের কারণে ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং ইরান হয়ে উঠেছে মানুষের অঙ্গ বিক্রির সবচেয়ে বড় কালো বাজার।

সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো হয়ে উঠেছে এই চক্রের নতুন কেন্দ্র এবং এখানেই কিডনি প্রতিস্থাপনের বেশিরভাগ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কিডনি পাচারকারী দলগুলোর একটির প্রধানকে ভারতে গ্রেপ্তারের পর ২০০৮ সালে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আইন কঠোর করে ভারত। আর এরপরই শ্রীলঙ্কা পরিণত হয় মূল কেন্দ্রে।

কিডনি বিক্রি চক্রের হোতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান অনুরাগ। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, কলম্বোর বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ডাক্তারদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেন বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক এজেন্ট। বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তাররাই। সম্পূর্ণ প্যাকেজের জন্য তাদের দাবি থাকে ৫৩ হাজার থেকে এক লাখ ২২ হাজার ডলার। এর মধ্যেই থাকে হাসপাতালের খরচ, ডাক্তারের বিল, দাতার টাকা, তার যাতায়াত এবং থাকার খরচ এবং দালালের কমিশনের টাকা। তার মতে, এটাই সবচেয়ে ভালো মাধ্যম কারণ এভাবে কারোর সময় নষ্ট হয় না কিংবা শিকার হতে হয় না ভোগান্তির। ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কায় পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনিও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবসার প্রসারণ

১৯৯০ সালের পর থেকেই এই অবৈধ ব্যবসা চলে আসলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই ব্যবসাকে দিয়েছে নতুন গতি। কিডনি প্রতিস্থাপনের সমর্থনে বিকাশ এবং আদর্শের রয়েছে প্রায় এক ডজন ফেসবুক পেজ।

এসব পেজের মাধ্যমেই চলে দাতা এবং ক্রেতার খোঁজ। যখনই কোনো দালাল এবং ক্রেতাদের চাহিদা মিলে যায় তখনই একটি লেনদেনের পর শুরু হয় কাজ। তবে এক্ষেত্রে অনেক গোপনীয়তা অবলম্বন করেন দালালরা। নিজের পরিচয় গোপন এবং ছদ্মবেশের মাধ্যমেই তারা এ কাজ করেন।

আল জাজিরা যখন বিকাশের সাথে প্রথম যোগাযোগ করে তখন তিনি নিজেকে প্রিয়াংকা সিং বলে পরিচয় দেন।

এই ছদ্মবেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘লোকজন সুন্দর তরুণীদের বেশি বিশ্বাস করেন। এজন্যই এ পন্থা। তরুণীর পরিচয় দিলেও যখন ফোন আসে তখন আমিই ফোনটি রিসিভ করি এবং বলি ও আমার ছোট বোন। আগে আমি নিজেকে বিদেশি বলে পরিচয় দিতাম কারণ লোকজন মনে করত তারা একজন বিদেশির সাথে কথা বলছে সুতরাং তারা হয়তো বেশি টাকা পাবে।’

‘তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রয়েছে কঠোর নজরদারি। আর এজন্যই আমি পাঁচ-ছয় সপ্তাহ পরপরই নাম পরিবর্তন করি এবং সেখানে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরগুলোর ব্যবহার বন্ধ করে দেই। দেখা করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার পরই আমি কারো সাথে দেখা করি। আমি এমন কোনো লোকের সাথেও যোগাযোগ করি না, যার সাথে আমার পূর্বে কথা হয়েছে। আপনিও পরের মাসে আমকে খুঁজে পাবেন না।’ -বলেন বিকাশ।

দালালরা জানান, তারা সব সময় চেষ্টা করেন ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী অধূমপায়ী পুরুষদের জোগাড় করতে। কারণ তারা সহজেই বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন। যাদের পাসপোর্ট আছে তাদের অগ্রাধিকার আরো বেশি। যখন কোনো দাতাকে বিশ্বাস করা যায় তখন তাকে নিউ দিল্লি এবং উত্তর প্রদেশের পরিচিত প্যাথলজিতে পাঠানো হয় রক্ত এবং টিস্যু পরীক্ষার জন্য।

এরপর ওই ল্যাব প্যাথলজি রিপোর্টগুলো আমাদের কাছে পাঠায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে তারা কলম্বোর ডাক্তারদের কাছেও সরাসরি পাঠিয়ে দেন রিপোর্টগুলো। চেন্নাইতে থাকা কেউ ওই পরীক্ষার টাকাগুলো পরিশোধ করেন। পরীক্ষার পর যদি সবকিছু মিলে যায় তবে ওই দাতার সাথে যোগাযোগ করে তাকে কলম্বো পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সবকিছু ঠিকভাবে পাওয়ার পর যদি পাসপোর্টের দরকার হয় তবে এমন লোকদের সাথে যোগাযোগ করা হয়, যারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাসপোর্ট করে দিতে পারেন।

প্রচুর টাকা আয়ের মাধ্যম

বিকাশ জানান, অনেক সময় দাতাদের মুম্বাইতে নিয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে তিনিই সকল কিছু করেন। দাতাদের সাথে তিনি বেশিরভাগ সময়ই নিউ দিল্লির রেল স্টেশনে দেখা করেন এবং সেখান থেকেই মুম্বাইয়ের ট্রেনে ওঠেন। তবে দাতা যদি নিরক্ষর হন তাহলে একা যেতে পীড়াপীড়ি করেন।

বিকাশ বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী আমি নির্ধারিত হোটেল কিংবা গেস্ট হাউজ কিংবা স্থানে রেখে রাখি আসি তাদের। আমার টাকা সবসময়ই রিসিপশনে রাখা থাকে। অনেক সময় হয়তো আইএসডি ফোনে তাদের সাথে যোগাযোগ করি এবং তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি এগিয়ে যাই এবং আমার কমিশনের টাকা গ্রহণ করি। তবে টাকা নেয়ার পর দাতার সাথে আমার আর দেখা হয় না। ওই দাতাকে অন্য কোনো এজেন্ট কলম্বোতে নিয়ে যান অপারেশনের জন্য।

প্রথমবার যখন কিডনি দাতা পেয়েছিলেন বিকাশ তখন পেয়েছিলেন ২৫ হাজার রুপি কিন্তু এখন তিনি প্রতি দাতার বিনিময়ে পান ৫০ থেকে ৮০ হাজার রুপি। গত বছর তিনি আটজন দাতাকে পেয়েছিলেন এবং প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি রুপি আয় করেন।

দালালদের তথ্যানুযায়ী, যেসব দাতাদের পাসপোর্টের খরচ দেয়া থাকে তাদের প্রায় চার লাখ রুপি দেয়া হয় অপারেশনের দুই দিন আগে। যাদের পাসপোর্ট দালালরা করেন তাদের দেয়া হয় তিন লাখ রুপি।

দালাল এবং দাতা দুজনই কলম্বোতে খুব উচ্চ মানের হোটেলে থাকেন, যেখান আধা কিলোমিটার দূরত্বেই রয়েছে তিনটি হাসপাতাল যারা এ কাজের সাথে যুক্ত। দাতারা সাধারণত ১৮ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে বাড়িতে ফিরতে পারেন।

আদর্শ বলেন, একবার এক সার্জন আমাকে বলেছিলেন তিনি প্রতি অপারেশনের জন্য পান প্রায় তিন লাখ শ্রীলঙ্কান রুপি। তবে সিনিয়ররা এর চাইতেও বেশি নিতে পারেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলো সবসময় বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের টাকা দেন যাতে তারা দেশে প্রবেশের সময় দাতাদের কোনো রকম প্রশ্ন না করেন। যদিও তাদের কাছে ভ্রমণ ভিসা থাকে, তবে কর্মকর্তারা জানেন এরা আসলে কিডনিদাতা।

শ্রীলঙ্কায় এমন ঘটনা ঘটছে একথা জানার পর ২০১১ সালে দেশটি আইন করে বিদেশিদের শ্রীলঙ্কান নাগরিকদের কিডনি নেয়া বন্ধ ঘোষণা করেন। শ্রীলংকায় যদি কোনো বিদেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে চান তবে সেক্ষেত্রেও আইন রয়েছে দেশটিতে। এক্ষেত্রে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়কেই একই দেশের নাগরিক হতে হবে। তবে এরপরও খুব চাতুরতার সাথে শ্রীলঙ্কায় চলছে এ কাজ।

বিকাশ বলেন, আপনার টাকার পরিমান যদি কম হয় আপনি পশ্চিম বাংলায় গিয়ে ১৭ লাখ রুপির মধ্যে এ প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেন। সেখানে বেশ কিছু স্থানীয় এজেন্ট আছেন যারা নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে দাতা সংগ্রহ করেন। তবে আমি কখনোই এরকম চুক্তিতে যাই না কারণ আমার বেশি টাকার দরকার।

টাকা আয়ের এত বেশি দরকার হলে তিনি সরাসরি শ্রীলংকায় গিয়ে কাজ করেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যে কমিশন পাই তার পরিমান বেশ ভালো। আমি কখনোই সেখানে যাব না, কারণ টাকা বেশি দিলেও আমি তাদের বিশ্বাস করি না। আমাকে দেখুন আমিও হয়তো ভালো একজন দাতা হব তাদের কাছে। তারা যদি আমার কিডনি নিয়ে নেয় তবে কি করব?

সূত্র: আল জাজিরা



মন্তব্য চালু নেই