থ্রিজি নিয়ে হতাশায় সেলফোন অপারেটররা

থ্রিজি থেকে ব্যবসায়িক সাফল্য। এর পর দ্রুতই ফোরজিতে স্থানান্তর। এমন প্রত্যাশা থেকেই থ্রিজি সেবায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করে অপারেটররা। কিন্তু থ্রিজিতে সাফল্য পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার থ্রিজি-পরবর্তী প্রযুক্তি ফোরজি চলে এলেও তাতে যেতে পারছে না সেলফোন কোম্পানিগুলো। ফলে থ্রিজিতে বিনিয়োগ হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। এর পর চার অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল তৃতীয় প্রজন্মের এ প্রযুক্তির সেবাদানের লাইসেন্স পায়। একই বছরের ৭ অক্টোবর গ্রামীণফোন, ২১ অক্টোবর বাংলালিংক, ৩০ অক্টোবর রবি ও ৭ নভেম্বর এয়ারটেল বাণিজ্যিকভাবে সেবাটি চালু করে।

তরঙ্গ বরাদ্দ ও লাইসেন্স গ্রহণ বাবদই চার সেলফোন অপারেটরকে ব্যয় করতে হয় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে গ্রামীণফোন একাই বিনিয়োগ করেছে ১ হাজার ৬৩৩ কোটি এবং অন্য তিন প্রতিষ্ঠান ৮১৬ কোটি টাকা করে। পাশাপাশি নেটওয়ার্ক অবকাঠামো উন্নয়নেও বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হয়েছে অপারেটরদের।

সেলফোন অপারেটরদের বাণিজ্যিক সফলতা নির্ভর করে মূলত গ্রাহক সংখ্যার ওপর। টুজির ক্ষেত্রে অপারেটররা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও পিছিয়ে রয়েছে থ্রিজির ক্ষেত্রে। খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণা বলছে, দেশে থ্রিজির গ্রাহক প্রবৃদ্ধির হার অনেকটাই ধীর। সেলফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে থ্রিজির প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক শ্লথ। বিদ্যমান গতিতে প্রবৃদ্ধি হলে থ্রিজির গ্রাহক সংখ্যা টুজিকে ছাড়িয়ে যেতে ২০২০ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে।

এসব কারণে বাণিজ্যিক সাফল্যের ক্ষেত্রে থ্রিজিকে গ্রহণযোগ্য মনে করছে না খোদ সেলফোন অপারেটররাই। একাধিক অপারেটরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রযুক্তি নিরপেক্ষ সেবার অনুমতি দেয়ার সুযোগ থাকলেও তা না করে প্রযুক্তি নির্দিষ্ট করে তরঙ্গের নিলাম আয়োজন করা হয়। এতে বাধ্য হয়েই থ্রিজিতে বিনিয়োগ করতে হয়েছে অপারেটরদের। লাইসেন্স নিতে ব্যয়ের পাশাপাশি থ্রিজি নেটওয়ার্ক উন্নয়নেও এরই মধ্যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। থ্রিজিতে বিনিয়োগ করা এ অর্থ তুলে আনতে এক দশকের বেশি সময় লাগবে।

থ্রিজির লাইসেন্স পাওয়া রবি আজিয়াটার ভাইস প্রেসিডেন্ট (কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি) ইকরাম কবীর বলেন, নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ও পুরনো প্রযুক্তির প্রতিস্থাপনে সেলফোন অপারেটরদের বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। আর সবসময়ই এ ধরনের বিনিয়োগের লক্ষ্য থাকে দীর্ঘমেয়াদি। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে থ্রিজিতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি আশা করছে রবি। এর মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে থ্রিজি নেটওয়ার্কের স্থায়িত্ব ও গুরুত্ব।

তিনি বলেন, বিনিয়োগের পরিমাণ এ খাত থেকে প্রত্যাশিত সাফল্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা নয়। বরং তরঙ্গের উচ্চমূল্য ও উচ্চহারের করভার সেলফোন অপারেটরদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনার ক্ষেত্রে হতাশা তৈরি করছে।

গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান নরওয়েভিত্তিক টেলিনর। এক দশকের মধ্যেই নরওয়েতে টুজি প্রযুক্তি বন্ধের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে অপারেটরটি। টেলিনর নরওয়ের ডিরেক্টর অব কাভারেজ অ্যামুন্ডসেন সম্প্রতি জানান, বেশ কয়েকটি শহরে লং টার্ম ইভোল্যুশন (এলটিই) বা ফোরজি প্রযুক্তি চালু হয়েছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বিদ্যমান টুজি নেটওয়ার্কের সমপরিমাণ এলটিই নেটওয়ার্ক স্থাপন সম্ভব হবে। আর এক দশকের মধ্যে পর্যায়ক্রমে টুজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হবে। তবে তার আগেই বন্ধ করা হবে থ্রিজি নেটওয়ার্ক।

তথ্যমতে, বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে এরই মধ্যে এলটিই প্রযুক্তির সেবা চালু হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতে এলটিই চালু হয় ২০১২ সালের এপ্রিলে। ভারতী এয়ারটেল দেশটিতে প্রথম এ সেবা চালু করে। আরেক অপারেটর এয়ারসেল এ প্রযুক্তির সেবাদান শুরু করে ২০১৪ সালে।

বাণিজ্যিকভাবে থ্রিজি পরিষেবা চালুর পর ২০১৩ সালের নভেম্বরে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বণিক বার্তা। থ্রিজি নিয়ে অপারেটরদের স্বপ্নভঙ্গ হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরের বছর থ্রিজি পরিষেবা নিয়ে উন্মাদনা কমতে শুরু করেছে জানিয়ে আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আর এখন খোদ অপারেটরদের কাছ থেকেই হতাশার এ চিত্র উঠে আসছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সচিব ও সংস্থাটির মুখপাত্র সরওয়ার আলম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই থ্রিজি প্রযুক্তির সেবা চালুর লাইসেন্স দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে পরবর্তী প্রযুক্তির সেবাও চালু করা হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর বিনিয়োগ করবে অপারেটররা।

থ্রিজি নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০১ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম সেবাটি চালু করে জাপানের এনটিটি ডোকোমো। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশে ৫৩৭টি অপারেটরের থ্রিজি প্রযুক্তির সেবা চালু রয়েছে। যদিও বৈশ্বিকভাবেই থ্রিজির সাফল্য উল্লেখ করার মতো নয়। গ্লোবাল মোবাইল সাপ্লায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সেলফোন সংযোগের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি। এর মাত্র ১০ শতাংশ থ্রিজি গ্রাহক।

বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এপ্রিল শেষে দেশে সেলফোনের গ্রাহক সংখ্যা ১২ কোটি ৪৭ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক ৫ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার, বাংলালিংকের ৩ কোটি ২০ লাখ ৪৪ হাজার, রবি আজিয়াটার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৩০ হাজার, এয়ারটেলের ৮৩ লাখ ৫১ হাজার, টেলিটকের ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ও সিটিসেলের ১২ লাখ ৩০ হাজার। একই সময়ে ইন্টারনেট সংযোগ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার। এর সিংহভাগই ব্যবহার করছে সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবা। প্রতিষ্ঠানগুলোর ইন্টারনেট সেবার সংযোগ সংখ্যা ৪ কোটি ৪২ লাখ ২৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে থ্রিজির গ্রাহক মাত্র ১ কোটি ৬১ লাখ। #বি.বার্তা



মন্তব্য চালু নেই