‘তুমি প্রধানমন্ত্রী হবা’ বাংলাদেশি কন্যা শারমিনকে দোয়া

‘যুক্তরাষ্ট্রের “সেক্রেটারি অব স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডব্লিউসি) ২০১৭” পুরস্কার নিয়ে ফেরার পর একজন দোয়া করে বলেছেন, তুমি প্রধানমন্ত্রী হবা। কিন্তু আমার চিন্তাভাবনা ছিল আইনজীবী হব। পুরস্কার পাওয়ার পর মনে হচ্ছে আরও বড় কিছু হতে হবে।’

নিজের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে লেখাপড়ার পথে অটল থাকা ঝালকাঠির সেই সাহসী মেয়ে শারমিন আক্তার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার পর এভাবেই তার অনুভূতি প্রকাশ করেছে। সে জানিয়েছে, ‘এ পুরস্কার শুধু আমার জন্য নয়, আমার দেশের সব মেয়ের জন্য। আমি চাই, ওরা আমার মতো কিছু করুক, প্রতিবাদ করুক।’

আজ বুধবার রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠানে শারমিন তার স্বপ্নের কথা জানায়। একই সঙ্গে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করে, মেয়েরা নিজেরা নিজেদের অসহায় ভাবে। ভাবে ছেলেরা বেশি শক্তিশালী। কিন্তু তা নয়। মেয়েরা বিপদে পড়লে পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ সাহায্য করবে। পুলিশ না করলে শিক্ষক, সহপাঠী বা কেউ না কেউ করবেই।

আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া প্রসঙ্গে শারমিন জানায়, ‘আমি নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকাইলাম। প্রথম আলো আমারে নিয়ে নিউজ করল। চ্যানেল আইয়ের স্বর্ণ কিশোরী ফাউন্ডেশন আমারে পুরস্কার দিল। আমেরিকান সেন্টার আমারে খুঁইজা পেল। তারপর আমেরিকা গিয়া পুরস্কার নিলাম।’

মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত মিট দ্য প্রেসে শারমিন জানায়, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে পুরস্কার পাওয়া নারীরা আমার কথা জানতে চান। আমি আমেরিকার হোয়াইট হাউস ও সংসদে গেছি। আমেরিকানদের সঙ্গে ডিনার করি। নিউইয়র্কের একটি স্কুলে যাই। ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানতে চায় আমি তাদের সাহায্য করব কি না। আমি বলি, সাহায্য করব।’

এসএসসির ফলের অপেক্ষায় থাকা শারমিন আক্তার জানায়, বাংলাদেশ সময় গত ২৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি শারমিনকে জড়িয়েও ধরেছিলেন। সে জানায়, ‘আমেরিকা থেকে একটা জিনিস শিইখা আসছি। ওই দেশে বাল্যবিবাহ দিলে কোনো আইন নাই। বাংলাদেশে কিন্তু আইন আছে। তাই এই আইন কাজে লাগাইতে হবে। বাবা-মা মেয়েদের লেখাপড়া করাক। তাঁরা মেয়েদের যাতে বোঝা মনে না করেন। যে বাবা-মা মেয়ের বাল্যবিবাহ দেবেন, তাঁদের শাস্তি দিতে হবে। আর মেয়েদেরও প্রতিবাদ করতে হবে। তাদেরও বলতে হবে, আমি লেখাপড়া করব, বিয়ে করব না।’

২০১৫ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শারমিনের মা তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে বান্ধবীর সহযোগিতায় স্থানীয় এক সাংবাদিকের কাছে ঘটনার কথা জানায়। তারপর সাংবাদিকের সাহায্যে থানায় গিয়ে মা ও কথিত স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। শারমিনের বাবা কবির হোসেন সৌদি আরবে থাকেন। ঘটনার পর শারমিনের মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। শারমিন এখন তার দাদি দেলোয়ারা বেগমের সঙ্গে থাকে। বর্তমানে শারমিনের মা এবং অন্য আসামি জামিনে আছেন।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পুরস্কার নিয়ে আসার পর থেকে শারমিনের এখন ব্যস্ত সময় কাটছে। মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার গিয়েছিল রাজধানীর লালবাগ মডেল হাইস্কুলে। ওই স্কুলের প্রায় ১০০ জন মেয়ে শারমিনকে বলেছে, পড়া শেষ না করে তারা বিয়ে করবে না। জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে তারাও শারমিনের মতো প্রতিবাদ করবে।

মিট দ্য প্রেসে উপস্থিত মার্কিন দূতাবাসের প্রধান প্রেস কর্মকর্তা মেরিনা ইয়াসমিন বলেন, শারমিন মাত্র ১৫ বছর বয়সে সংগ্রাম করেছে, সংগ্রামে সে সফলও হয়েছে। শারমিন এখন অন্য কিশোরীদের কাছে সাহস ও অনুপ্রেরণার নাম। এ সময় মার্কিন দূতাবাসের প্রেস অ্যাসিস্ট্যান্ট নুসরাত হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

গত বছর ৮ নভেম্বর প্রথম আলোর নারীমঞ্চ পাতায় ‘সাহসী এক শারমিনের কথা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে শারমিনের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল। এরপর গত বছর প্রথম আলোর ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘অধিনায়ক ও নায়কেরা’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার প্রিয় চার নায়কের সংগ্রামী জীবনের ঘটনা তুলে ধরা হয়। এই চার নায়কের একজন ছিল শারমিন। রেদওয়ান রনি এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রামাণ্যচিত্রটি দেখানো হয়। পরে প্রামাণ্যচিত্রটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়।



মন্তব্য চালু নেই