তিন মানব পাচারকারীর অর্থ পাচারের খোঁজে দুদক

চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন মানব পাচারকারীর অর্থ পাচারের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)।

এরা হলেন মোহাম্মদ ফারুক, নুরুল কবির ও আবু সৈয়দ। যারা চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানবপাচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানেও মিলেছে এর সত্যতা।

এর আগে চলতি বছরের ১ জুন দুদকের সংবাদ সম্মেলনে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতদের অগাধ সম্পদ ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের বিষয়ে অনুসন্ধানের ঘোষণা দেয় দুদক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে সম্প্রতি ওই তিন পাচারকারীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে দুদকের তিন কর্মকর্তাকে পৃথক পৃথক অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুদকের একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, পানছড়িপাড়া, সাবরং, টেকনাফ, কক্সবাজার অঞ্চল থেকে মানবপাচারের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে মোহাম্মদ ফারুকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এরপরই দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদকে অনুসন্ধানকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে এ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

অন্যদিকে ফুলেরডেইল, হ্নীলা, টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চল থেকে মানবপাচারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা অর্থপাচারের অভিযোগে নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে। ১৩৯ ‍পৃষ্ঠার অভিযোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টের ভিত্তিতে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে।

একইভাবে মানবপাচার করার মাধ্যমে অর্থপাচারের অভিযোগ আবু সৈয়দের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। তার বিরুদ্ধে শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়া, সাবরাং, টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবপাচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানেও তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগটি দুদককে খতিয়ে দেখার জন্য অনুরোধ করা হয়।

আর ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের সহকারী পরিচালক মোজাম্মিল হোসেনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে অভিযোগটি টাঙ্গাইল জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আমির হোসেন অভিযোগটি অনুসন্ধান করেছেন। চলতি বছরের শেষের দিকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অনুসন্ধানে গতি আনতে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় কমিশন।

দুদক সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক মাসেই ৬০টি বিশ্লেষণ প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর মধ্যে বিএফআইইউ থেকে দুদক ও সিআইডির কাছে ৩২টি বিশ্লেষণ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধানে নামে দুদক।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসী আয়ের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন সপ্তম। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী বৈধভাবে বিদেশে গেছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকে অবৈধপথে বিদেশ গমনের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫৩ হাজার বাংলাদেশি। আর ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় তিন বছরে সাগরপথে পাচার হওয়া মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার।

অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং জনশক্তি রফতানিকারকরা বলছেন, অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। এজন্য তারা সরকারিভাবে জনশক্তি রফতানির ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করতে ২০১৩ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন হয়েছে। ২০১২ সালে হয় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন। এসব আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু। কিন্তু কঠোর আইন, জীবনের ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা কোনো কিছুই অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে পারছে না। বরং বেড়েছে।

এদিকে অবৈধপথে মানবপাচারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা কৌশলে বেড়েছে অর্থপাচারের পরিমান। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য মতে, ২০০৪ থেকে ২০১৩ এক দশকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে ২০১৩ সালে। যার পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর আগের বছর পাচার হয় ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে অবৈধ অর্থপ্রবাহ বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।



মন্তব্য চালু নেই