২৮তম সম্মেলন

তিন গ্রুপে বিভক্ত ছাত্রলীগ

ছাত্রলীগের ২৮তম সম্মেলন আগামী ২৫ ও ২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলন হলেও কমিটি ঘোষণা হয়নি। সম্মেলনকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। তবে এ প্রাণচাঞ্চল্যের মাঝেও দুই বলয়ের তিনটি গ্রুপ আসন্ন কমিটিতে তাদের প্রাধান্য বিস্তারে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। এমনটিই জানা গেছে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গত প্রায় দেড় দশক ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করছে একটি বলয়। এখনো সেই বলয়টির হাতেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। তবে, গত কাউন্সিলে প্রতিষ্ঠিত এই বলয়েরই আরেক নেতা নিজের একজন অনুসারীকে প্রার্থী দিয়ে পুরনো বলয় থেকে বেরিয়ে যান। তৈরী হয় একটি উপ-বলয়ের।

২০১১ সালের ১০ ও ১১ জুলাই অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে মূল বলয় থেকে দেওয়া প্রার্থীরাই কাউন্সিলে বেরিয়ে আসে। নিজের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে উপ-বলয় তৈরীর চেষ্টাকারী নেতা অনভিজ্ঞতার কাছে হেরে যান।

এই দুই বলয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছাত্রলীগের সাবেক দুই জন সভাপতি। মূল বলয়ের নেতৃত্বে আছেন ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি লিয়াকত শিকদার। উপ-বলয়ের নেতৃত্বে আছেন ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা মাহমুদ হাসান রিপন।

ছাত্রলীগের গত সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে লিয়াকত শিকদারের প্যানেল প্রার্থী ছিলেন এইচ এম বদিউজ্জামান ও সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ওই সময়ের (২০১১) সভাপতির দায়িত্বে থাকা মাহমুদ হাসান রিপনের প্যানেল ঘোষিত হয় মনোয়ারুল ইসলাম মাসুদ ও শামসুল কবীর রাহাতের নামে। সম্মেলনে শিকদার প্যানেল দুই পদেই জয়ী হয়।

দুই বলয়ের নেপথ্যে : ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হওয়া ছাত্রলীগের ২৬তম কাউন্সিলে সভাপতি পদে মাহমুদ হাসান রিপন ও সাধারণ সম্পাদক পদে মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন নির্বাচিত হন। তবে অভিযোগ রয়েছে ওই কাউন্সিলে ভোটিংয়ের পর সম্মেলন স্থলে ভোট গণনা না করে গণভবনে শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে ভোট গণনার কথা বলে ভোট বাক্স নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

ওই সময়ের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা এই প্রতিবেদকের কাছে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই কাউন্সিলে সভাপতি পদে প্রকৃত পক্ষে বেশী ভোট পেয়েছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী কামরুল হাসান রিপন। কিন্তু লিয়াকত বলয়ের পছন্দ ছিল মাহমুদ হাসান রিপন। আর তাকে সভাপতি ঘোষণা করার জন্যই ভোট বাক্স নিয়ে গিয়ে জানানো হয় নতুন কমিটির নাম।

সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সংগঠন পরিচালনা ও বিভিন্ন জেলা কমিটি গঠন করতে গিয়ে লিয়াকত শিকদারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হয় মাহমুদ হাসান রিপনের। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতা শেখ হাসিনার কাছে নিজেকে সাব্যস্ত নেতা হিসেবে তুলে ধরতে সমর্থ হন রিপন। ফলে শেখ হাসিনার কাছে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরতেও সমর্থ হন লিয়াকতের হাতে নেতা হওয়া রিপন।

তিন গ্রুপ : ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মধুর ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্পটে নেতাকেন্দ্রিক আড্ডাতেই রাজনৈতিক শক্তিমত্তার পরিচয় তুলে ধরেন নেতারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির নেতাদের কেন্দ্র করে উল্লেখ করার মতো তিনটি আড্ডা হয় ক্যাম্পাসে। পিয়ারু (বেগম রোকেয়া হলের পাশে), হাকিম চত্বর ও মিলন চত্বর। এই তিন স্থানই মূলত ছাত্রলীগের তিন কেন্দ্রীয় নেতা ও তাদের অনুসারীদের আড্ডার জায়গা হিসেবে পরিচিত।

উল্লিখিত স্থানের ক্রমানুসারে এ সব আড্ডা হয় ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমূল আলম ও ১ নম্বর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবীর রাহাতের অনুসারীদের উপস্থিতিতে। সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর এ সব আড্ডাতে উপস্থিতির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একই বলয়ের (শিকদার) হলেও তাদের অনুসারীরা আলাদা আলাদা আড্ডা দেন। এই দুই জনের বাইরে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবীর রাহাত কেন্দ্রিক একমাত্র আড্ডা হয়।

রাহাত মূলত মাহমুদ হাসান রিপনের অনুসারী। গত কাউন্সিলে মাসুদ-রাহাত পরিষদের মধ্যে মাসুদের বয়সসীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় রিপনের প্রতিনিধি হিসেবে রাহাত সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা গেছে। তবে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বয়স না থাকায় নতুন কাউন্সিলে তাদের কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেন না।

গ্রুপ থাকলেও সংঘর্ষ নেই : ছাত্রলীগ তিনটি গ্রুপে বিভক্ত থাকলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার পরিস্থিতি কমই হয়। বিভিন্ন বিষয়ে মতদ্বৈততার কারণে কোনো কোনো সময় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করলেও প্রকাশ্য সংঘর্ষের চিত্র বর্তমান কমিটিতে দেখা যায়নি। তবে গত ৮ মে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর রাহাতের অনুসারী কেন্দ্রীয় উপ-সম্পাদক রাজেশ সিংহকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার ও ক্যাম্পাসে লাঞ্ছিত করাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সম্মেলনকে সামনে রেখে কোনো গোলমালের ফাঁদে পা না দেওয়ার কৌশলের কারণে বিষয়টি তেমন বড় হয়নি।

ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, শামসুল কবীর রাহাত গত চার বছর সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো নিজস্ব গ্রুপ নিয়েই ক্যাম্পাসে অবস্থান করেছে। তার বয়সকে কেন্দ্র করে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করায় বোঝা যায়, লিয়াকত বলয় রাহাতের প্রার্থিতা নিয়ে চিন্তিত।

অন্যদিকে, সাবেক হলেও বর্তমান কমিটিতে মাহমুদ হাসান রিপনের অনেক অনুসারী আছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার আগের সম্পর্ক এখনো বজায় রাখতে পেরেছেন। তাই ছাত্রলীগের অন্যান্য ইউনিট নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড মাথা না ঘামালেও কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে ঠিকই মতামত দেন। আর সেই ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার কাছ থেকে দূরে থাকা লিয়াকত শিকদারের চেয়ে মাহমুদ হাসান রিপনের এগিয়ে থাকার ইঙ্গিত মিলছে।

এ বিষয়ে মন্তব্য চাইলে লিয়াকত শিকদার বলেন, ‘বরাবরই ছাত্রলীগের সম্মেলন এলে আমার নামে অতিরঞ্জন হয়। এবারও তাই হচ্ছে। বস্তুত আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে এখন আর সম্পৃক্ত নই।’

বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘ছাত্রলীগে কোনো গ্রুপিং-টুপিং নেই। ছাত্রলীগ একক সংগঠন। দেশরত্ন শেখ হাসিনাই আমাদের অভিভাবক। এর বাইরে কারো প্রভাব ছাত্রলীগে নেই।’

তবে, এই বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য মাহমুদ হাসান রিপনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। ছাত্রলীগ নিয়ে বর্তমান নেতারা কথা বলবেন। আমি সম্মেলন উপলক্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই।’



মন্তব্য চালু নেই