আসছে মাহে রমজান

তারাবির নামাজকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিন

আসছে মাহে রমজান। তারাবির নামাজ এ মাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। এই নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। রাসুলুল্লাহ (সা.) তিন দিন এই নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করেন। কিন্তু নিয়মিত সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করলে তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই পরবর্তী সময়ে তিনি আর জামাতের সঙ্গে তা আদায় করেননি।
হজরত ওমর (রা.)-এর যুগে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবির নামাজ পড়ার প্রচলন ঘটে এবং সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা সুন্নত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা এত বড় সওয়াবের একটি ইবাদতকে অত্যন্ত গুরুত্বহীনতার সঙ্গে আদায় করে থাকি। তারাবির নামাজ মূলত আরামের নামাজ। তারাবি ‘তারবিহাতুন’-এর বহুবচন। ‘তারবিহাতুন’ শব্দের অর্থই হলো আরাম করা, বিশ্রাম করা। ইসলামী শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী এই নামাজে প্রতি চার রাকাত পর চার রাকাত পরিমাণ বসে আরাম করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয় ভিন্ন চিত্র। রমজান এলে যেসব মসজিদে খতম তারাবি হয়, সেসব মসজিদে বলতে গেলে এক ধরনের অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কার আগে কে শেষ করতে পারে, কে কত দ্রুত পড়তে পারে, সেটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে কোরআন তেলাওয়াতের সাধারণ নিয়মাবলি ও আদবের প্রতিও লক্ষ করা হয় না। বরং কোরআনের সঙ্গে চরম বেয়াদবি করা হয়।

তা ছাড়া মুসল্লিরা এভাবে নামাজ পড়ে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে দ্রুত নামাজ শেষ করার নির্দেশও থাকে। হাফেজ সাহেবরা সে নির্দেশের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামাজ শেষ করার চেষ্টা করে থাকেন। এর অনিবার্য ফল এই দাঁড়ায় যে, কিরাতের শেষের দু-একটি শব্দ ছাড়া আর কিছুই মুসল্লিরা বুঝতে পারে না। ট্রেনের গতিতে হাফেজ সাহেব কোরআন পড়ে যান আর মুসল্লিরা পেছনে থেকে ঘুমায় বা ঝিমায়। কোরআন শ্রবণ দ্বারা মুসল্লিদের অন্তরে যে স্বাদ অনুভব করার কথা বা যে আবেগময়তা সৃষ্টি হওয়ার কথা, সেটা হয় না। এতে অনেকের নামাজের মনোযোগিতা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। তারাবির নামাজটা তাদের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই সারা দিন রোজা রেখে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ সময় তারাবির নামাজ পড়াটা খুবই কষ্টসাধ্য। তার ওপর আবার কোরআন তেলাওয়াত না বোঝার কারণে নামাজের প্রতি আরো বেশি অনীহা সৃষ্টি হয়। এ জন্যই তারাবির নামাজে প্রথম দিকে যে পরিমাণ মুসল্লি থাকে, রমজানের দিন যত যায়, মুসল্লির সংখ্যাও তত কমতে থাকে। শেষের দিকে এমন হয়- মসজিদ মুসল্লিশূন্য হয়ে যায়।

এভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা কোরআনের সঙ্গে চরম বেয়াদবির শামিল। এরূপ নামাজে তারাবির সোয়াব তো দূরের কথা, বরং কোরআন নিয়ে তামাশা করার কারণে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কোরআনুল কারিম তেলাওয়াতের সাধারণ যে নিয়মাবলি রয়েছে, তার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।

কোরআনুল কারিমে সুরা মুয্যাম্মিলের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেন, ‘হে নবী! আপনি কোরআন তেলাওয়াত করুন স্পষ্ট উচ্চারণে, ধীরে ধীরে।’ এই আয়াতে ‘তারতিল’ শব্দটি উল্লেখ আছে। তারতিল অর্থ হলো অন্তর্নিহিত অর্থের প্রতি খেয়াল করে, স্পষ্ট উচ্চারণে ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করা। রাতের নামাজে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তেলাওয়াত কেমন ছিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে নবীপত্নী হজরত উম্মে সালমা (রা.) নবীজির অনুকরণে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনান। তাতে প্রতিটি হরফ স্পষ্ট ছিল। (জামে তিরমিজি)

কোরআন যথাসাধ্য সুমিষ্ট ও সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াত করা উচিত। সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াতের প্রতি ইসলামী শরিয়ত গুরুত্ব দিয়েছে। হজরত আলকামা (রা.) একবার এক ব্যক্তিকে কোরআন তেলাওয়াত করতে শুনে বলেন, ‘লাকাদ রাত্তালাল কোরআনা, ফিদাহু আবি ও উম্মি’- অর্থাৎ ‘লোকটি তারতিলের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত করেছে। তার প্রতি আমার মা-বাবা উৎসর্গ হোক।’

এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। হাফেজ সাহেবকে ভাবতে হবে যে তারাবির রুহু বা প্রাণ হলো কোরআন তেলাওয়াত। এভাবে কোরআন তেলাওয়াতের দ্বারা কোরআনের আজমত তো রক্ষা হয়ই না; বরং কোরআনের সঙ্গে চরম বেয়াদবি ও ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা হয়। তাই এত দ্রুত কোরআন তেলাওয়াত করা যাবে না যে তেলাওয়াতের কিছুই বোঝা যায় না। আবার এত ধীরেও পড়া যাবে না যে মুসল্লিদের কষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে হাফেজ সাহেবরা বাইতুল্লাহ শরিফ ও মসজিদে নববীর তেলাওয়াতের অনুকরণ করতে পারেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ইমাম, খতিব ও হাফেজ সাহেবরা মুসল্লিদের বোঝাতে পারেন। একটু কষ্ট স্বীকার করে হলেও কোরআন তেলাওয়াত শোনার প্রতি উৎসাহিত করতে পারেন। আশা করি মুসল্লিরা তা সানন্দে গ্রহণ করবে এবং তাদের অন্তরে আল্লাহতাআলার কালামের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা বেড়ে যাবে।

মসজিদ কমিটিকে ভাবতে হবে, এত কষ্ট করে নামাজ পড়ে সামান্য একটু সময়ের সাশ্রয় করতে গিয়ে পুরো নামাজের সোয়াবই বিনষ্ট করার কোনো মানে হয় না। নিজের সব কাজ ঠিক থাকবে, আবার আল্লাহতাআলার কাছে অফুরন্ত পুণ্যের আশা করব- এটা তো হতে পারে না। যেখানে এত দীর্ঘ সময় নামাজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম, সেখানে সামান্য সময়ের জন্য এমনকি আহামরি ক্ষতি হয়ে যাবে! বরং এটা হচ্ছে শয়তানের ধোঁকা। আমরা যদি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই, তাহলে ধীরস্থিরভাবে নামাজ পড়াটা অসম্ভব কিছু নয়। এ ছাড়া এতে সময় খুব বেশি সাশ্রয় হয় না। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, তারতিলের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত আর দ্রুততার সঙ্গে তেলাওয়াতের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য হয় না। সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ মিনিটের কম-বেশি হয়। তাই মসজিদ কমিটি ও সাধারণ মুসল্লিদের উচিত, একটু বিলম্ব হলে বিরক্তি প্রকাশ না করে বরং ধীরস্থিরভাবে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে হাফেজ সাহেবদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করা। কারণ হাফেজ সাহেবরা নির্বিঘ্নে নামাজ পড়ানোর জন্য তাঁদের ঐকান্তিক সহযোগিতা একান্ত জরুরি।

তারাবির নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে সমাজের ভেতর একটি সুবিধাবাদী গ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। যারা আট রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করে দাবি করে থাকে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে আট রাকাত তারাবির নামাজ আদায়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। তারা তাহাজ্জুদবিষয়ক একটি সহিহ হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে তারাবির ব্যাপারে প্রয়োগ করে। আর এই প্রয়োগকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বলে, তাহাজ্জুদ নামাজ ও তারাবির নামাজ অভিন্ন। যে নামাজ ১১ মাস তাহাজ্জুদ থাকে, তা-ই রমজানে তারাবি হয়ে যায়। অথচ তাহাজ্জুদ ও তারাবি এক নামাজ- এটি সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয় এবং এটাও প্রমাণিত নয় যে, তাহাজ্জুদ নামাজ আট রাকাতের বেশি পড়া যায় না। সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, তাহাজ্জুদ নামাজ আট রাকাতের বেশি পড়া যাবে। এর কোনো সংখ্যা নির্ধারিত নয়। দুই দুই রাকাত করে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যত ইচ্ছা পড়া যায়। (বুখারি, হা: ১১৩৭, মুসলিম, হা: ৭৪৯)

তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রে বর্ণিত উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি যদি তারাবির ক্ষেত্রে হতো (তাঁদের দাবি অনুযায়ী) তাহলে অবিরাম চল্লিশ বছর (১৪ হিজরি থেকে হজরত আয়েশা (রা.)-এর মৃত্যু সন ৫৭ হিজরি পর্যন্ত) তাঁর হুজরাসংলগ্ন মসজিদে নববীতে যে ২০ রাকাত তারাবি হয়েছে, তার ওপর কি হজরত আয়েশা (রা.) আপত্তি করেছেন? তাঁর কাছে তারাবির রাকাত সংখ্যা নির্ধারণের ব্যাপারে একটি অকাট্য হাদিস থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ চল্লিশ বছর হাদিসটির বিরোধিতার ওপর তিনি নিশ্চুপ থাকবেন, তা হতে পারে না। মোদ্দা কথা, খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাহ, মুহাজির ও আনসারি সাহাবিদের ইজমা, অন্য সাহাবিদের ইজমা এবং অন্য সব অকাট্য দলিলের বিপরীতে তাদের কাছে চারটি দলিল রয়েছে। যার একটি তাহাজ্জুদের হাদিস, যা অন্যায়ভাবে ভুল ব্যাখ্যা করে তারাবির ব্যাপারে প্রয়োগ করা হয়। দুটি মুনকার ও অতি দুর্বল রেওয়ায়েত, যা বর্ণনার দিক থেকে ভুল হওয়ার পাশাপাশি মূল বিষয়ই অস্পষ্ট। আর সর্বশেষ একজন রাবির ভুল বিবরণ, যেখানে তিনি ভুলক্রমে ১১ রাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং একটি হাদিসের অপব্যাখ্যা, তিনটি মুনকার ও ভুল বর্ণনার আশ্রয় নিয়ে তারা গোটা উম্মাহর সঙ্গে ধৃষ্টতা দেখানোর মতো দুঃসাহস করছে। তর্কের খাতিরে যদি তাদের দলিল মেনেও নেওয়া হয়, তার পরও তাদের উদ্দেশে প্রশ্ন হলো, ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায়ের বর্ণনাও তো হাদিস শরিফেই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ২০ রাকাত আদায় করতে আপনাদের অসুবিধাটা কোথায়? রাসুলুল্লাহ (সা.) কমবেশি তারাবির নামাজ আদায়ের ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি এই ইবাদত নিয়মিত আদায় করলে উম্মতের ওপর তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ থেকেই তো বোঝা যায়, তারাবি মুসলমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। খোলাফায়ে রাশেদিন ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের আমল ২০ রাকাতের ওপর। হজরত ওমর ফারুক (রা.) তাঁর শাসনামলে ২০ রাকাত তারাবি আদায়ের জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ জারি করে তা বাস্তবায়ন করেছেন। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত দৃঢ়ভাবে ধারণ করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪৬০৭, জামে তিরমিজি ৫/৪৩, হাদিস নম্বর ২৬৭৬, মুসনাদে আহমাদ ৪/১২৬, হাদিস নম্বর ১৬৬৯২, সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস নম্বর ৪২, সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নম্বর ৫) অতএব, বোঝা গেল, কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াস ২০ রাকাত তারাবির পক্ষে। সুতরাং গুরুত্বের সঙ্গে ২০ রাকাত তারাবি সব মুসলমানের প্রতিপালন করা জরুরি একটি বিষয়। রাকাতসংখ্যার বিবাদে পড়ার কোনো অবকাশ নেই।



মন্তব্য চালু নেই