ঢাবি’র সেই ৯ সন্দেহভাজন জঙ্গি এখন কোথায়?

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ ছাত্রকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কৃত ছাত্ররা হলেন, আলম মো. শিহাব উদ্দিন ও সাঈদী হাসান সজীব, নাকিব ফারহান, আলমগীর হোসেন, তারিকুল ইসলাম, মো. সোলাইমান ও আব্দুল মতিন। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়টির মহিউদ্দিন ও গোলাম মাওলা নামে ২ শিক্ষকও সংগঠনটির উচ্চ পর্যায়ের নেতা বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, মহিউদ্দিন আত্মগোপনে রয়েছেন এবং গোলাম মাওলা নিজ কর্মস্থলে কর্মরত আছেন। সম্প্রতি জঙ্গি হামলায় কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা উচিত নয় জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর আমজাদ আলী জানিয়েছেন, ওই ৭ শিক্ষার্থীসহ দুই শিক্ষকের ওপর কঠোর নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে।

প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে হিযবুত তাহরীরের লিফলেট ও সিডি বিতরণ করেন ৭ ছাত্র। পরে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তদন্ত করে ওই ৭ ছাত্রকে চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষ। ওই ছাত্রদের নামে থানায় মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় তাদের সবাইকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরও জানায়, পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হলে তাদের সবাইকে আটক করে। ৭ ছাত্রের মধ্যে ৫ জন জামিনে মুক্ত আছেন। বাকি দু’জন কারাগারে রয়েছে। দুই ছাত্রের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মো. সোলাইমান। অন্যজন আব্দুল মতিন, যিনি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাসটার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন।

এদিকে, হিযবুত তাহরীর প্রধান সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) শিক্ষক মহিউদ্দীন আহমেদ ২০১০ সালে গ্রেফতার হন। পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান বলে পুলিশের দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জানান, মহিউদ্দীন আহমেদ জামিনে মুক্ত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত বেতনও পাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর সরকার হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে মহিউদ্দীনকে আর কর্মস্থলে দেখা যায়নি। তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন তাও জানেন না এ বিভাগের কেউই।

জানা গেছে, হিযবুত তাহরীর অন্য এক নেতা ও উপদেষ্টা ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলাকে ২০১০ সালের ৮ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশ এলিফ্যান্ট রোড থেকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হলেও তিনি এখন জামিনে রয়েছেন। জামিনে মুক্তির পর থেকে তিনি তার নিজ কর্মস্থলে কর্মরত রয়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

জামিনে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ছাত্রের মধ্যে নুরে আলম মো. শিহাব উদ্দিন ও সাঈদী হাসান সজীব দুজনেই ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্র ছিলেন। নাকিব ফারহান, আলমগীর হোসেন এবং তারিকুল ইসলাম অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্র নুরে আলম মো. শিহাব উদ্দিনের স্থায়ী ঠিকানা জামালাপুরে সরেজমিনে গেলে জামালাপুর প্রতিনিধিকে শিহাবের বাবা তোজাম্মেল হোসেন জানান, বর্তমানে শিহাব তার বড় বোনের বাসা ঢাকার হাজারীবাগে থাকেন। তিনি এখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শ্রেণিতে পড়ছেন। কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন জানতে চাইলে তিনি তা জানেন না বলে জানিয়েছেন শিহাবের বাবা। কিন্তু এর একদিন পরে তোজাম্মেল হোসেন এ প্রতিবেদকে মোবাইল ফোনে বলেন, আমার ছেলে এখন আর পড়াশোনা করে না। সে তার বোনের বাসায় থাকে এবং চাকরি খুঁজছে, পাশাপাশি টিউশনি করে।

শিহাবের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তোজাম্মেল হোসেন তার মেয়ে শিল্পীর ফোন নম্বর দেন। কিন্তু ওই মোবাইল ফোনে কল করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে শিহাবের বাবা তার মেয়ে শিল্পীর বাড়ির ঠিকানাও দিতে পারেননি।

শিহাব হিযবুত তাহরীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিহাবকে সন্দেহবশত গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। গ্রেফতারের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে সে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেয়। শিহাবের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর নেই জানিয়ে বাবা তোজাম্মেল হোসেন আরও জানান, মোবাইলে ছেলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না হলেও মেয়ের মোবাইলের মাধ্যমে শিহাবের সঙ্গে কথা বলেন।

ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আরেক ছাত্র সাঈদ হাসান সজীবের স্থায়ী ঠিকানা টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায়। সরেজমিনে গিয়ে টাঙ্গাইল প্রতিনিধি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তারা ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু কোথায় গিয়েছেন সেটাও কেউ জানেন না।

সজীবের প্রতিবেশী চা বিক্রেতা মো. মামুন বলেন, তারা অনেকদিন ধরেই গ্রামে আসেন না। শুধু ঈদের সময় সজিবের বাবা আসতো। এখন তাও আসা বন্ধ করে দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সজীবের কোনও সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মামুন বলেন, কিছুদিন আগে শুনেছিলাম হিজবুত তাহরীর সংগঠনের সঙ্গে কাজ করে বলে পুলিশ ধরেছিল। পরে আবার শুনেছি এই খবর মিথ্যা।

এদিকে, সজীবের চাচাত ভাই বাদলকে খুঁজে পাওয়া গেলে তিনি বলেন, সজীবদের পরিবারের সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ নেই। তারা এখন কোথায় থাকেন তাও জানেন না। সজীব কোনও একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে তিনি শুনেছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন নাকিব ফারহান। স্থায়ী বহিষ্কার হওয়ার পর তাকে আর হলে দেখা যায়নি বলে জানায় সূর্যসেন হল কর্তৃপক্ষ।

নাকিবের স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামের ঘাট ফারহাবাদের কাজেম আলী রোডের গুলিস্তান হাইটস। সরেজমিনে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানতে পারেন, তারা এখন আর ওই ভবনে থাকেন না। স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত প্রায় ৬ মাস আগে তারা কোনও এক অজানা কারণে ওই বাড়ি থেকে চলে গেছেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাকিবের পরিবার মূলত পাকিস্তানি। ওই ভবনের যারা থাকেন, তারা সবাই পাকিস্তানি বলে জানা গেছে।

গুলিস্তান হাইটসের কেয়ারটেকার আব্দুর রহমান জানান, তারা ৬ মাস আগে ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু কোথায় চলে গিয়েছে তা জানি না। তবে নাকিবের বাবা ব্যাংকে চাকরি করেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের বহিষ্কৃত ছাত্র তারিকুল ইসলামের বাড়ি রাজধানীর খিলগাঁও। খোঁজ নিতে গিয়েও তাদের কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি।

এছাড়া, বহিষ্কৃত ছাত্র আলমগীর হোসেনের স্থানীয় ঠিকানায় খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ এম আমজাদ আলী বলেন, আমরা যখন সিসি ফুটেজ দেখে তদন্ত করে বুঝতে পারি ওই ৭ ছাত্র হিযবুত তাহরীরের সদস্য, তখনই প্রাথমিকভাবে তাদের সাময়িক বহিষ্কার করি। পরে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তারা তার জবাব দেয়নি। পরে সিন্ডিকেট সভায় তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছি।

তবে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং শিক্ষকদের ওপর নজরদারি করা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের কাজ করেছি। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত তাদের ওপর নজরদারি করা—তারা আসলেই শুদ্ধ হয়ে গেছে নাকি জঙ্গিবাদের সঙ্গে সক্রিয় আছে।

এ এম আমজাদ আলী আরও বলেন, সোলায়মান নামে যে ছাত্রকে আটক করা হয়, তার কাছ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করি। সেখানে প্রায় ২৯ জনের নামের তালিকা পেয়েছিলাম। কিন্তু ওই নামের তালিকা অনুসারে খুঁজে আমরা কাউকে পাইনি। হয়ত সেখানে কারও ছদ্ম নাম অথবা ডাক নাম ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গোলাম মাওলা জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি তার বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। মহীউদ্দিন আহমেদকে বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়েছে। খবর বাংলা ট্রিবিউন।



মন্তব্য চালু নেই