ঢাকা বেতারে যা ঘটেছিল সেদিন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট। রক্তগঙ্গার বিনিময়ে আসা স্বাধীনতা পেরিয়েছে মাত্র তিন বছর নয় মাস। আজকের মতো ঘরে ঘরে তখন এতো পত্রিকাও ছিল না, টেলিভিশনও ছিল না। ছিল শুধুই বাংলাদেশ বেতার। সারাদেশের ছয়টি আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে একযোগে প্রচার হওয়ার কারণে বেতার ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সেজন্যই রাতের অন্ধকারে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বেতার কেন্দ্র দখলই ছিল প্রধান অস্ত্র। তেমনটিই ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ঘাতক দল প্রথমেই দখলে নেয় শাহবাগে বেতারের ঢাকার আঞ্চলিক কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘোষণাও আসে সেখান থেকেই।

সেই রাতে শিফট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন বেতার প্রকৌশলী প্রণব চন্দ্র রায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের সাক্ষ্য প্রদানকালে তার দেয়া জবানবন্দিতে এ সব তথ্য জানা যায়। ফজরের আজানের ধ্বনি তখনও প্রতিধ্বনিত্ব হচ্ছে চারপাশে। ঠিক সেই সময়ে এ দেশের কিছু কুলাঙ্গারের মারণাস্ত্রের গুলিতে ধানমণ্ডির নিজ বাসভবনের সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি— যেখানে রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা, সেখানেই মৃত্যুর শীতল পরশ ছুঁয়ে যায় বঙ্গবন্ধু ও তার স্ত্রী-পুত্রসহ পুরো পরিবারকে। সেখান থেকে ভোর পৌনে ৬টার দিকে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী একদল সৈন্য বেতার ভবনে প্রবেশ করে বিনাবাধায় দখল নেয়। বেতার ভবন দখলের ২-৩ মিনিট পরই তারা শিফট ইনচার্জ প্রণব চন্দ্র রায়ের কক্ষে প্রবেশ করে। সৈন্য দলের একজন নিজেকে মেজর ডালিম পরিচয় দিয়ে চিৎকার করে জানতে চায়— শিফট ইনচার্জ কে? প্রণব বাবু নিজের পরিচয় দেয়ার পর ডালিম তার দিকে অস্ত্র তাক করে বলে, Sk. Mujib and all his gang has been killed and army has taken power’। প্রণবকে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখন বেতারে ঘোষণা দেব, ট্রান্সমিটার চালু করেন।’ মেজর ডালিমের অস্ত্রের মুখেই অন্য সহকর্মীদের নিয়ে প্রণব চন্দ্র রায় সব যন্ত্রপাতি চালু করেন।

এরপরই ডালিম কাগজপত্র নিয়ে বেতারের ঘোষণা লিখে। লিখতে লিখতেই বেতারের রিসিভার হাতে নিয়ে ডালিম হুমকি দিয়ে বলে— ‘এখন একটি ঘোষণা দেয়া হবে, যদি তা শোনা না যায় তাহলে সবাইকে শেষ করে ফেলবো।’ এ সময় প্রণব চন্দ্র রায় তাকে জানান, কল্যাণপুর ট্রান্সমিটার চালু না হলে কোনো অনুষ্ঠান শোনা যাবে না। তখন সেখানে ফোন করে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয় ডালিম। এরপর প্রণব রায় বেতারের ম্যাগনেটো টেলিফোন লাইনে কল্যাণপুর ট্রান্সমিটার কেন্দ্রের শিফট ইনচার্জ আবদুল লতিফকে পান।

তাকে বলেন, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমার সামনে আছে, আপনি ট্রান্সমিটার অন করিয়া দিন’; কিন্তু আবদুল লতিফ প্রণব চন্দ্র রায়ের কথা বিশ্বাস না করে, তিনি পাগল হয়ে গেছেন কি না জিজ্ঞাসা করেন। কথোপকথন বুঝতে পেরে ডালিম নিজে রিসিভার নিয়ে আবদুল লতিফকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এবং ট্রান্সমিটার অন করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিছুক্ষণ পরই সেটি অন হয়ে যায়।

এরপরই মেজর শরিফুল হক ডালিম বেতারে ঘোষণা দেয়, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে। খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। কারফিউ জারি করা হইয়াছে।’ এই ঘোষণা বারবার প্রচার হতে থাকে। তবে অন্য আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, সেদিন ডালিম ঘোষণা দিয়েছিল অনেকটা এ রকম— ‘স্বৈরাচারী মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে।… বাংলাদেশ এখন একটি ইসলামী রাষ্ট্র…।’ তবে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ওই সময় বাংলাদেশ বেতারের কার্যক্রম শুরু হতো পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত ও বাংলায় তরজমা প্রচারের মধ্য দিয়ে। এরপর অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ ও তরজমা, হামদ-নাদ, অনুষ্ঠান সূচি, দেশের গান ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রচার হতো; কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো দিনটি শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘোষণা প্রচারের মধ্য দিয়ে। ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও পাকিস্তানের অনুসরণে নতুন নাম রাখা হয় ‘রেডিও বাংলাদেশ’।

১৫ আগস্ট ভোর ৭টার সময় খন্দকার মোশতাক বেতার ভবনে প্রবেশ করেন। সঙ্গে আসেন বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। মোশতাকের পাশে তিনি স্বহস্তে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ভাষণ লিখে দেন। এরপর মোশতাক শাহবাগ বেতার কেন্দ্রে বসেই ভাষণ পাঠ করেন, যা সকাল ৮টা থেকে প্রচার শুরু হয়। তাহের উদ্দিন ঠাকুর এরপর লিখতে বসেন বিভিন্ন বাহিনীপ্রধানের ভাষণ। পর্যায়ক্রমে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএইচ খান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান নূরুল ইসলাম এবং রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নূরুজ্জামানের স্ব স্ব কণ্ঠে রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়। বেতার সূত্রে জানা যায়, ওই সময় বেতারের দুই নম্বর স্টুডিওটি ছিল ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত। ওই স্টুডিওটি দখলদাররা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে। কক্ষটির দায়িত্বে ছিল মেজর শাহরিয়ার।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের সাক্ষ্য প্রদানকালে প্রণব চন্দ্র রায় জানান, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তিনি ১৫ আগস্ট সকালে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনী প্রধানের কথাবার্তা চলার সময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকেও দেখেছিলেন। এছাড়া তিনি সেনাবাহিনীর লোকদের দ্বারা রক্ষীবাহিনীর কতিপয় নিরস্ত্র সদস্যকে পুলিশ ব্যারাকের সামনের মাঠে বসিয়ে রাখতে দেখেছেন। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা তিনি জানেন না।

ওই সময় বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন আশফাকুর রহমান খান। তিনি সাক্ষ্য প্রদানকালে জানিয়েছিলেন, ১৫ আগস্ট বেতার ভবনে আসতেই তাকে ইন্টারকমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ডেকে পাঠায় মেজর শাহরিয়ার। তিনি গিয়ে দেখেন অল্পবয়সী ওই সেনা কর্মকর্তা টেবিলের ওপরে স্টেনগান রেখে বসে আছে। মেজর শাহরিয়ার তখন তাকে বেতারের নতুন ‘পলিসি’ কী হবে সে নিয়ে নির্দেশনা দেয়, যাতে ছিল— বেতারের নাম হবে ‘রেডিও বাংলাদেশ’; বঙ্গবন্ধু, জয়বাংলা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার ইত্যাদি উচ্চারণ করা যাবে না; শেখ মুজিব সংক্রান্ত কোনো ধরনের তথ্য প্রচার করা যাবে না; অনুষ্ঠান সূচির অনুমোদন নিতে হবে; গান-বাজনাসহ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বেশি প্রচার করতে হবে। এসবই করা হয়েছিল যাতে দেশের জনগণ মনে করে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি স্বাভাবিক।

আশফাকুর রহমান খান জানান, সব মিলিয়ে ওই সময় ঢাকা বেতার কেন্দ্রে ছিল এক ভীতিকর পরিস্থিতি। সর্বত্র বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের সশস্ত্র প্রহরা। তারা স্টুডিওকে ব্যবহার করতো নিজেদের মনমতো। ওই সময় ৬ নম্বর স্টুডিও ছিল মিলনায়তন, যা সেনা সদস্যরা নির্যাতন কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতো। আগস্টের পরও বেশ কয়েক মাস সেনা নিয়ন্ত্রণে ছিল ঢাকা বেতার কেন্দ্র।



মন্তব্য চালু নেই