ডিমলার শতবর্ষী চিনি ’বু’র ইতি কথা

হামিদা আক্তার স্মৃতি : চিনি ’বু’র বয়স কি হবে দেড়’শ বছর। তা যদিও না হয় তবে কমপক্ষে চিনি বু’র বয়স হবে এক’শ তিরিশ বছরের উপরে। চিনি ’বু’ এলাকার সবার বু। কথাগুলি বলছিলেন গ্রামের বয়োজৈষ্ঠ্যরা। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমি যখন ছোট তখনই চিনি বু’কে দেখেছি বুড়ি। শুনেছি আমার বাবাকে কোলে নিয়েছেন। বাবা মৃত বরণ করেন প্রায় ৬০/৬৫ বছর বয়সে। চিনি বু’র সত্যিকারে বয়স কত হবে এটা কেহই বলতে পারেন না। একই কথা বলেন গ্রাম ডাক্তার রফিকুল ইসলাম, উন্নয়ন কর্মী অজিবর রহমান লেবু, নুরুল হক প্রমূখ। শতবর্ষী চিনি ’বু’ এখনও হাট বাজারে গিয়ে নিজে যা খায় তা পছন্দ করে নিয়ে আসেন বাড়ীতে অনায়াসে। চিনি ’বু’র পছন্দ ধনিয়া পাতা ও বাবড়ি শাক। চিনি বু’র কথা এলাকার মানুষের কাছে শুনে ছুটে যাই তার বাড়ীতে। কথা হয় সকলের চেনা মুখ চিনি বু’র সাথে, তিনি জানালেন তার জীবনের ঘটে যাওয়া সে অনেক কথা। ন্যাশনাল আইডি কার্ডে জন্ম তারিখ ৪ ফ্রেব্রুয়ারী/১৯১৮। সে অনুযায়ী চিনি বু’র বয়স প্রায় এক’শ বছর। কিন্তু প্রতিবেশী বৃদ্ধরা জানান চিনি বু’র বয়স অনেক বেশী আমরা ছোট বেলায় চিনি বু’কে দেখিছি বুড়ি। এখনও সে বুড়ি। তাই সে এখন এলাকার সবার ’বু’।

নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের উ:সুন্দর খাতা গ্রামের মৃত মহিম উদ্দিনের স্ত্রী শতবর্ষী এই চিনিফুল বেওয়া। স্বামী মৃত বরণ করেন অনেক আগেই। এই মূর্হুতে মনে নেই চিনি বু’র। তিন ছেলে ওমর আলী (৭৫), ওসমান আলী (৭২), আবুল হোসেন (৬২) ও পাঁচ মেয়ে মর্জিনা (৫৮), বাচ্চাই (৫৫), দুলাই (৪৫), হাসিনা (৪২) ও ধুলপি বেগম ( ৩৮) এদের মধ্যে বেঁচে আছেন ধুলপি,বাচ্চাই, দুলাই ও আবুল। চিনি বু’র নাতি-নাতনী রয়েছে ২২ জন, পুতি-পুতনী রয়েছে ২৫জন পুতি-পুতিনীর সন্তানদেরকেও দেখার সৌভাগ্যে হয়েছে এই চিনি বু’র। বয়সের ভারে নুজ্জে পড়া চিনি বু’কে হাটে বাজারে লোকজন দেখে অনেক কিছু খাওয়াতে চাইলেও তিনি কারও কিছু মুখে দেন না। ভূমিহীন চিনিফুল বেওয়ার বাবা-মায়ের বংশের কেহই বেঁচে নেই। বেঁচে নেই শশুড়-শাশুড়ীর বংশের কেহ। চিান বু’র মেয়ে ধুলপি ও দুলাই জানান, এখনও আমার মা নিজে রান্না করে খান। তিনি কারও রান্না পছন্দ করেন না। নিজে কোন কারনে যদি রান্না করতে না পারেন তাহলে পাশে বসে রান্না দেখিয়ে দিবেন তবেই তিনি খাবেন। মা এখনও সব কিছু করতে পারেন। মন যা চায় তিনি বাজার থেকে নিজে নিয়ে আসেন।

প্রতিবেদকের সাথে একান্তে কথপোকথনে জানা যায়, চিনি ফুলের জীবনের অনেক স্মৃতিই এখন বিম্মৃতির অথৈই জ্বলে তলিয়ে গেছে। মনে নেই দীর্ঘ এ জীবনের সূখ-দু:খের গল্পগুলি। দুই মেয়ের আশ্রয়ে থাকা চিনি ’বু’ জানান, জীবনের শেষ বেলায় এসে আর কোন দু:খ্য নেই আমার। এ জীবনে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু খেয়েছি, অনেককে জন্মাতে দেখেছি, দেখেছি তাদেরকে চোখের সামনে মরতে। নিজের গর্ভের সন্তানদের দেখেছি মরতে। দু’চোখে নিজেকে ভাঁসিয়ে তাদেরকে পরপারে বিদায় জানিয়েছি। দেশে যুদ্ধ দেখেছি। বাড়ীর পাশেই দেখিছি অনেককে গুলি করে মেরে ফেলতে। পশ্চিম পাকিস্থানের পুলিশ মেরে ফেলেছে তাদেরকে। আমি তখন মধ্যবয়সী নারী। স্বামী সংসার আছে। আমাদের বাড়ীতেও ঐ লম্বা লম্বা পুলিশ এসেছিল। তখন আমরা চটি (চট) গায়ে দিয়ে থাকতাম। যাতে তাদের চোখে না পরি। তারপরও তারা খুঁজে বের করতো। আমাকে পাবে কিভাবে ? আমি তো তাদের দেখেই পালাতাম। লুকিয়ে থাকতাম বাড়ীর পাশেই, জঙ্গল ছিলো সেখানেই। আসত ছাগল-মুরগী-ডিম খুঁছতে। পেলে ধরে নিয়ে গিয়ে খেত। না দিলে বাড়ীর সবাইকে মারতো শারীরিক নির্যাতন করতো। সে দু:খের কথা মনে পড়লে এখনও দু’চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই মারা যায় আমার স্বামী। এভাবেই কথাগুলি বলছিল চিনি বু। এখন কানে একটু কম শুনে। তবে চোখে ভাল দেখেন তিনি। বলছিলো, আমার বাড়ীর পাশে শহীদ মিনার হইছে (হয়েছে) না ? সেখানে অনেক লোক (মানুষ)কে মেরে ফেলেছে যুদ্ধের সময় (যা এখন ডাঙ্গারহাট ট্রাজেডি নামে পরিচিত)। অনেক যুবতী নারীকে ধরে নিয়ে গেছে তারা। কি করছে, মনে নেই। বলতে পারবো না।

কিভাবে দিন কাটে আপনার ? প্রশ্নের জবাবে বলেন, অতি কষ্টে জীবনের শেষ সময়টা পার করছি। দিন কাটে খেয়ে না খেয়ে। বয়স্ক ভাতা পাই, তা দিয়েই জ্বলে আমার জীবন প্রদ্বীপ। কবে নিভে যাবো ? তা কি আর বলতে পারি বইন (বোন)। আমাগো (আমার ) দিন শেষ। তোমরা বেঁচে থাক যুগযুগ ধরে। এত কথা শুইনা (শুনে) কি করবা (করবে) ? কারে এসব কথা শুনাইবা (শুনাবা) ? এই চোখে অনেক কিছু দেখেছি বইন (বোন), অনেক কিছু। চিনি বু’র শেষ ইচ্ছা বলতে কিছু নেই। চিনি বু সম্পূর্ন সুস্থ্য শরীরে জীবন যাপন করছে। তার নেই কোন অসুস্থ্যতা। রোগ বালাই নেই তার দেহে। সুতরাং বয়োজৈষ্ট্য এলাকাবাসীরা ধারনা করছেন চিনি বু’ আরো অনেক দিন বাঁচবেন।

লেখক : সাংবাদিক



মন্তব্য চালু নেই