সমন্বয়হীনতায় অকেজো সিগনাল টাইমার

যানজট রাজধানীবাসীর একটি নিত্যনৈমিত্তিক ভোগান্তির কারণ। যানজটের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময় রাস্তায় নষ্ট হচ্ছে। মাত্রারিক্ত যানবাহন এবং সে তুলনায় রাস্তার অপ্রতুলতার কারণেই দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে যানজটের লাইন। তবে এ যানজট নিরসনে সরকার বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। এবারও যানজট কমাতে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহয়তায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রাফিক সিগনালগুলোতে অটোমেটিক কাউন-ডাউন টাইমার ডিভাইস স্থাপনসহ আধুনিকায়ন করছে। কিন্তু এবারও সফলতার মুখ দেখছে না ডিএসসিসির এই উদ্যোগ। ডিএসসিসি ও ডিএমপির সমন্বয়হীনতার কারণেই কোটি কোটি টাকার প্রকল্প শেষমেষ ভেস্তে যেতে বসেছে। টাইমার নয়, হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। তবে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি অস্বীকার করেছে ডিএসসিসি ও ডিএমপি।

তবে ডিএসসিসি সূত্র বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন ইন্টারসেকশনে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে যেসব প্রযুক্তি সরবারাহ করা হয়েছে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে না। ডিএসসিরি একক মালিকানার কারণেই নাকি ডিএমপি (ট্রাফিক) এ প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে দূরে রয়েছে।’

এদিকে টাইমার ডিভাইসের মাধ্যমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হলে রাজধানী যানজট কিছুটা কমবে বলে দাবি করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এছাড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলেও মনে করছেন সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটি। তাদের দাবি, ঢাকার ইন্টারসেকশন গুলোতে এ অটোমেটিক টাইমার ডিভাইসের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন পড়বে না। তাদের অন্য জায়গায় কাজে লাগোনো যাবে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন ‘আকাশ ছোঁয়া’ স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবতা একেবারেই উল্টো। রাজধানীর বিভিন্ন সিগনালে কাউন-ডাউন টাইমার লাগানো হলেও এখনো এ সম্পর্কে জানানেন না ট্রাফিক সিগনালে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা। তাদের না জানিয়েই সিটি করপোরেশন সিগনালে টাইমার ডিভাইস লাগিয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। এছাড়া কাউন-ডাউন টাইমার পুরোদমে চালু হলে রাজধানীর যানজট নিরসন তো দূরের কথা,যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা।

ডিএসসিসি জানায়, বর্তমানে রাজধানীর ৭০টি সিগনাল পয়েন্টে পরীক্ষামূলকভাবে এই টাইমার ডিভাইস লাগানো হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্রতিটা সিগনালেই এই কাউন-ডাউন টাইমার লাগানো হবে। সম্পন্ন হওয়া প্রজেক্টটি খুব শিগগিরিই ডিএমপির কাছে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, ‘এই টাইমারের সাহায্যে চালকরা জানতে পারবেন কোন সিগনালে তাদের কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সিগানলের কন্ট্রোল রুম থেকে অটোমেটিক নিয়ন্ত্রণ করা হবে টাইমারগুলো। লাল সিগনাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গণনা শুরু হবে। পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১৪০ সেকেন্ড ও সর্বনিম্ন ৩৮ সেকেন্ড সময় বেঁধে দেয়া হবে। এছাড়া অফপিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১২০ সেকেন্ড ও সর্বনিম্ন ২০ সেকেন্ড পর পর সবুজ বাতি জ্বলবে। তবে পরিস্থিতি বুঝে এই সময় কম-বেশি হতে পারে।

সিটি করপোরেশন আরো জানায়, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ক্লিন অ্যায়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেইস) প্রজেক্টেরে আওতায় যানজট নিরসন ও রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আরো সুশৃঙ্খল করতে ২০১২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন এ প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের বাস্তবায়নেরর মেয়াদ ধারা হয় ২০১৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১ লা জানুয়ারি ডিএমপির কাছে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর করার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এখনো সম্ভব হয়নি।

এদিকে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তার মোড় গুলোতে সিগনাল বাতি এবং কাউন-ডাউন টাইমার লাগানো হলেও শাহবাগ মোড়ে হাতের ইশারায় দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক সার্জেন্ট হাবিব। সিগনাল বাতি ও টাইমার ডিভাইস ফলো না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিগনাল বাতি ও টাইমের দিকে তাকিয়ে গাড়ি ছাড়লে পুরো রাজধানীই স্থবির হয়ে যাবে। সম্প্রতি কাওরান বাজার মোড়ে এক ঘণ্টা টাইমার ফলো করে যানবাহন ছাড়া হয়েছিল। ওই এক ঘণ্টায় যানজোটের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘এ প্রযুক্তি আমাদের দেশের জন্য নয়, বাংলাদেশের রাস্তায় এক সঙ্গে রিকশা, ঠেলা গাড়ি, বাস, মাইক্রোবাস চলে। এগুলো উন্নত বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য।’

একই অভিযোগ করেন হোটেল রূপসীবাংলা মোড়ে দায়িত্বরত এক পুলিশ সার্জেন্ট। নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি বলেন, ‘রাস্তার তুলনায় যানবাহনের পরিমান অনেক বেশি। তাই যানবাহনের সংখ্যা না কমা পর্যন্ত যানজট নিরসনের কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না। ডিএমপির পক্ষ থেকে কাউন-ডাউন টাইমার ফলো করতে কোনো নির্দেশনা দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওই ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এই রকম কোনো নির্দেশনা আমাদের দেয়া হয়নি। এছাড়া এগুলো কবে কারা লাগিয়েছে এটাও আমাদের জানা নেই।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অটোমেটিক কাউন-ডাউন টাইমার ডিভাইস লাগানো হলেও এ বিষয়ে অজ্ঞ যানবাহন চালকরা। তাদেরকেও কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেয়া হয়নি।

প্রকল্প প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ক্লিন অ্যায়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেইস) প্রজেক্টের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান খান বলেন, ‘ ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক ও শৃঙ্খলা করতে ঢাকা সিটি করপোরেশন এই প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। এখন ডিএমপিকে হস্তান্তর করার অপেক্ষায় রয়েছি। তিনি জানান, কন্ট্রোলার, সোলার, পুল, চার্জার, ব্যাটারি, সিনগাল বাতিসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক।

কাউন-ডাউন টাইমার চালু হলে যানজট কমবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিগনাল বাতি ও কাউন-ডাউন চালু করলেই যানজট কমে যাবে, এটা আসলে সম্ভব নয়, এটা অসম্ভব ব্যাপার। তবে কিছুটা হলেও কমবে। তবে এ প্রজক্টের মাধ্যমে ট্রাফিক ব্যবস্থায় নতুনত্ব আসবে।’

সিগনালে দায়িত্বরত পুলিশ বাতি এবং টাইমার ফলো করছে না তাহলে কী ডিএমপি (ট্রাফিক) ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে কোনো সমন্বয়হীনতা রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমনটার প্রশ্নেই আসে না! ডিএমপির (ট্রাফিক) জয়েন্ট কমিশনার মুসলে উদ্দিন ও এডিসি নাবিদ কামাল শৈবাল সব সময় আমাদের সঙ্গে এ প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন। তাদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সিগনালে পরীক্ষামূলক চালু হওয়া টাউমার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, ‘এ প্রকল্পটি ঢাকা সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করছে। গত ৩১ ডিসেম্বর আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর করার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে ডিএসসিসি করতে পারেনি।

প্রতিটি সিগনালে এ অটোমেটিক সিস্টেম চালু হলে রাজধানীর যানজট দূর করতে কতটা সহায়ক হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে এটা বলা যাবে না। এখনো প্রকল্পটি পরীক্ষামূলক অবস্থায় রয়েছে। ডিএসসিসি ও ডিএমপির সমন্বয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে বলা যাবে।’



মন্তব্য চালু নেই