ডাক্তারী না পড়েও ৬ বছর ধরে ডাক্তার

খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় অভিনব এক ‘চিকিৎসকের’ দেখা মিলেছে। তিনি মাদ্রাসা থেকে এসএসসি সমমানের দাখিল পাস করেছেন। এরপর আর কোনো ধরনের পড়াশোনা না করেই ছয় বছর ধরে খুলনায় রোগী দেখছেন এবং ওষুধও দিচ্ছেন। এস এম মারুফ হোসাইন নামের ওই ব্যক্তি নগরীর ময়লাপোতা মোড়ে একটি চেম্বার খুলে নিয়মিত রোগী দেখছেন। নিজেকে ‘স্পেশালিস্ট মেডিসিন’ চিকিৎসক বলেও দাবি করেছেন।

রোগীদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘ডা. এস এম মারুফ হোসাইন, বিআইএএম [কলিকাতা] ডিএইচএমএসএস [ঢাকা] পাইলস ও নাকের পলিপাস স্পেশালিস্ট [মেডিসিন]।’ মারুফের বয়স ২৮ বা ২৯ বছর হতে পারে।

ময়লাপোতা মোড়ে মারুফের ওই চেম্বারের বাইরে দালালও থাকেন। ওই দালালরা রোগীদের নিয়ে আসেন মারুফের কাছে।

গত ২১ জুলাই মঙ্গলবার দুপুরে এনটিভির এই প্রতিবেদক ওই চেম্বারে যান। চেম্বারের সামনে পুরুষ ও নারীসহ ১০-১২ জন রোগী অপেক্ষা করছিলেন। দুই নারীসহ পাঁচজন চেম্বার তদারকি করছিলেন।

প্রতিনিধি হাজির হলেই তদারকি করা ব্যক্তিদের একজন এসে বলেন, ‘ডাক্তার দেখাবেন নাকি ভাই?’ হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলে তিনি বলেন, ‘ভাই, এমন ডাক্তার আর পাবেন না বাংলাদেশে। নিশ্চিত গ্যারান্টি দিয়ে রোগ সারা হয়।’

চিকিৎসকের এত বিশেষণ শোনার পর খুলনা ব্যুরোপ্রধানের ভিজিটিং কার্ড দিতেই চিত্র বদলাতে থাকে। ‘দেখা করতে এসেছি। রোগী দেখাতে নয়।’ বলার পর ডাক পড়ে এ প্রতিনিধির।

এস এম মারুফ হোসাইনের চেম্বারে ঢুকতেই দেখা গেল, নোংরা কক্ষের মধ্যে অস্ত্রোপচার করার যন্ত্রপাতি ছড়ানো ছিটানো আছে।

নামের পাশের ডাক্তার লেখা, কোন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন জানতে চাইলে মারুফ দাবি করেন, জেলার সিভিল সার্জন তাঁকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বেশ কিছু সময় কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন মারুফ। একপর্যায়ে তিনি জানান, ১৯৯৯ সালে মোল্লাহাট মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেছেন তিনি।

দাখিল পাস করে কীভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়েছেন এ প্রশ্নের জবাবে মারুফ বলেন, ‘আমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নই স্পেশালিস্ট, মেডিসিন ডাক্তার। আমি নিজে ওষুধ তৈরি করে রোগীকে দেই, তাই মেডিসিন স্পেশালিস্ট।

ওষুধ তৈরির অনুমতি আছে কি না জানতে চাইলে মারুফ দাবি করেন, ‘সিভিল সার্জনের রেজিস্ট্রেশন আছে।’

‘বিআইএএম কলিকাতা’ ডিগ্রির মানে জানতে চাইলে মারুফ বলেন, ‘বেসিক অব অ্যালোপেথিক মেডিসিন।’ একপর্যায়ে নিজেকে হোমিও চিকিৎসক হিসেবে দাবি করেন তিনি। রোগী দেখার ফি প্রসঙ্গে বলেন, কোনো ফি নেন না। কেবল ওষুধের দাম নেন।

কথা বলতে বলতেই নোংরা ময়লাযুক্ত আবর্জনার ওপর যন্ত্র দিয়ে যশোরের হজরত আলী নামের এক ব্যক্তির নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে পরিষ্কার করে দেন মারুফ হোসাইন। ফি জানতে চাইলে হজরত আলী বলেন, তিনি তিন হাজার টাকা চুক্তি করে আগাম টাকা দিয়ে দেখাচ্ছেন।

মারুফ হোসাইন দাবি করেন, সেরা চিকিৎসক হিসেবে তাঁকে (মারুফ) সম্মানিত করা হয়েছে। প্রমাণস্বরূপ তিনি বেশ কয়েক বছর আগের বিশাল আকৃতির লেমিনেট করা দুটি ছবি দেখান। ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকার সম্পাদক আলহাজ লিয়াকত আলীকে খুলনা ওয়াসার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করায় তৎকালীন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ইউনুসুর রহমান তাঁকে ক্রেস্ট দিচ্ছেন। আর মারুফ লিয়াকত আলীকে ফুল দিচ্ছেন।

Fake-Doctor-2

মারুফকে বলা হয়, এটা সেরা চিকিৎসককে ক্রেস্ট দেওয়ার কোনো ছবি নয়। তারপর মারুফ কিছুটা নীরব হয়ে মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকেন।

এস এম মারুফ হোসাইনের ব্যাপারে জানতে চাইলে খুলনার সিভিল সার্জন মো. ইয়াসিন আলী বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের ভুয়া চিকিৎসকের অভিযোগ আছে। কিন্তু লোকবল না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘র‌্যাব ঢাকা অফিসের গোয়েন্দা দল কয়েক মাস আগে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি ক্লিনিক সিলগালা করে আটজন ভুয়া চিকিৎসক আটক করেছিল। এরপর আবার সব ধীরে ধীরে এলাকা বদল করে আবারও অবৈধ কাজকর্ম করছেন।’

খুলনার স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মারুফ হোসাইন আগে শান্তিধাম মোড়ে চেম্বার ও ক্লিনিক করে রোগী দেখতেন। কিছু দিন আত্মগোপনে থেকে আবারও মারুফ ও তাঁর লোকজন এ তৎপরতা শুরু করেছেন।এনটিভি



মন্তব্য চালু নেই