ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচারে যেসব বাধা

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারকাজ থমকে আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ঘর-বাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে গত বছরের ১৮ আগস্ট জামায়াতের বিরুদ্ধে শুরু হয় তদন্ত। তবে ধীর গতির তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে এসেও যেন হলো না শেষ। এর অন্যতম প্রধান কারণ প্রসিকিউটরদের অন্তঃদ্বন্দ্ব ও পরস্পর কলহ। এমনকি বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শুধু এটিই নয় আরো বেশকিছু বাধা রয়েছে জামায়াতের বিচারের ক্ষেত্রে।

সূত্র মতে, একাত্তরে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও এর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে সংশ্লিষ্টদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সুপারিশ জানায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। এরপর গত ২৭ মার্চ জামায়াতের বিরুদ্ধে ৩৭৩ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনসহ ৯ হাজার ৫৫৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কাছে দাখিল করে তারা।

তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ৭ সদস্যের একটি প্যানেল চূড়ান্ত করা হয়। প্যানেলের সদস্যরা হলেন- ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, সুলতান মাহমুদ সীমন, সাইফুল ইসলাম, তাপস বল, জেয়াদ আল মালুম, রানাদাস গুপ্ত ও রেজিয়া সুলতানা চমন। এ প্যানেলে সমন্বয়ক করা হয় ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে। কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধে চূড়ান্ত প্যানেল তৈরি হলেও প্রয়োজনীয় নথির দেখা নেই। কারণ সেগুলো চিফ প্রসিকিউটরের আলমারিতে তালাবদ্ধ। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু চিকিৎসার জন্য রয়েছেন সিঙ্গাপুর।

এদিকে গত মাসে ট্রাইব্যুনালের অন্য এক প্রসিকিউটর সৈয়দ হয়িদার আলী ভারপ্রাপ্ত চিফের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর গত ১১ মে ভারপ্রাপ্ত প্রসিকিউটরের নেতৃত্বে প্রসিকিউটরদের মধ্যে প্রথম বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে, জামায়াত নিষিদ্ধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগের কার্যক্রম সিনিয়র প্রসিকিউটরদের মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হবে বলেও জানানো হয়। এছাড়া জামায়াত নিষিদ্ধের সব নথি ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর বরাবর জমা দেয়ার জন্য লিখিতভাবে বলা হয়।

গত ১৫ মে যাবতীয় নথি হস্তান্তরের বিষয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেন প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা। চিঠি হস্তান্তর করা হয় প্রসিকিউশন টিমের প্রধান ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে।

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘চিঠি ইস্যুর মাধ্যমে জামায়াত নিষিদ্ধের সব নথি ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটারের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত তেমন কোনো নথি আমাদের প্রসিকিউটর প্যানেলে হস্তান্তর করা হয়নি। সব নথি চিফ প্রসিকিউটরের রুমে স্টিলের আলমারিতে তালাবদ্ধ। যিনি চিঠি ইস্যু করেছেন, তিনি তার ক্ষমতার বাইরে এ কাজ করেছেন।’

তুরিন আফরোজের অভিযোগের সত্যতার বিষয়ে প্রসিকিউটর ঋষিকেস সাহা বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে আমরা একটি মিটিং করেছিলাম। নথি জমা দেয়ার বিষয়টি সেখানেই চূড়ান্ত হয়েছে। তাছাড়া আমি ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটরের আদেশ মোতাবেক চিঠি ইস্যু করেছি। এখানে কে আমাকে দোষারোপ করলো তা আমার দেখার বিষয় নয়।’

অপরদিকে ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের স্বার্থেই শুধু নথিপত্র চাওয়া হয়েছে। এখানে বিরুপ কোনো মনোভাবের প্রয়োজন দেখছি না। ইদানিং প্রসিকিউটরদের মধ্যে খুব বেশি সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করছি। আমরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রাখতে চাই। খুব শিগগিরই এ নিয়ে আমরা আরো একবার বৈঠকে বসতে চাই।’

প্রসিকিউসনের পরস্পর বিরোধ লেগে থাকলে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছা অসম্ভব বলে মনে করছেন ট্রাইব্যুনালের অন্য প্রসিকিউটররা। তবে প্রসিকিউসনের মধ্যে সমন্বয়ের লক্ষ্যে আইনমন্ত্রী এর আগেও তাদের (বিরোধপূর্ণ প্রসিকিউটরদের সঙ্গে) নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। তবে তার কোনো ভালো ফল আসেনি।

এদিকে জামায়াত নিষিদ্ধের বড় একটি বাধা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩ সংশোধন করে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের বিধান যুক্ত করা হলেও অপরাধী সংগঠনের শাস্তি কী হবে, তা উল্লেখ নেই। অবশ্য এ বিষয়ে কিছুটা যুক্তি খণ্ডন করেছেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।

তিনি বলেছেন, ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টে ‘ব্যক্তি’র (পারসন) সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কম্পানি, অ্যাসোসিয়েশন বা ব্যক্তিগোষ্ঠীও ‘ব্যক্তি’ বিবেচিত হবে। সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের আইনে ২০ ধারায় উল্লেখিত ‘ব্যক্তির’ মধ্যে সংগঠনও পড়বে। আর ট্রাইব্যুনালের যে কোনো সাজা দেয়ার ক্ষমতা আইনেই আছে। সাজার বিষয়ে তিনি বলেন- যাবজ্জীবন, ৯০ বছর বা আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজার বিষয় আইনে উল্লেখ নেই; তারপরও ‘যেকোনো সাজার’ আওতায় ট্রাইব্যুনাল ওই দণ্ড দিয়েছেন। সংগঠনের ক্ষেত্রেও একইভাবে শাস্তি দেয়া সম্ভব।

তবে তুরিন আফরোজ স্বীকার করেন, ‘অপরাধী সংগঠন’ হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা হলে বিচারের সময় এ বিষয়টি দু’পক্ষের মধ্যে অন্যতম আইনি বিতর্কের সৃষ্টি করবে।

এ বিষয়ে সেদোত্তর দিতে পারেননি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হকও। তিনি বলেন, ‘জামায়াতের বিচারে শাস্তি কী হবে এবং শাস্তি কে ভোগ করবে বিষয়টি ভাবতে হবে। ট্রাইব্যুনাল আইনে কোনো সংগঠনের বিচার বা শাস্তির বিধান নেই। আমাদের প্রচলতি আইনে (কোম্পানি আইন) সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শাস্তি হলে শাস্তি ভোগ করতে হয় পরিচালনা পর্ষদকে। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের সাজা ভোগ করবেন তাদের নেতারা।’

ইতিমধ্যে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকের ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছে। এর মধ্যে একজনের কার্যকরও হয়েছে। সেক্ষেত্রে কী হবে তা স্পষ্ট নয়। এমনকি মন্ত্রীও এ বিসয়ে কিছু বলেননি।

শুধু তাই নয়, জামায়াত নিষিদ্ধে আরো একটি বড় বাধা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরকারের একটি আপিল। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে গত বছর আগস্টে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। একই সঙ্গে এই আপিলে ট্রাইব্যুনালের রায়ের আলোকে একাত্তরে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা, গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবী হত্যা ইত্যাদি কাজে জড়িত থাকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার আবেদন করা হয়েছে। আপিল বিভাগে এ আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত একই অভিযোগে একই সংগঠনের বিরুদ্ধে অন্য কোনো আদালতে বিচার সম্ভব কি না তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।

এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘জামায়াতের নিবন্ধন বিষয়ে একটি মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এ অবস্থায় জামায়াতের বিষয় নিয়ে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি মামলার বিচার চললে পরিস্থিতি কী হবে তার বিবেচনা করতে হবে। কারণ একইসঙ্গে দুটি মামলার বিচার চলতে পারে কি না সেটি বিবেচনায় নিতে হবে।’

এদিকে সরকার জামায়াতে ইসলামীর বিচার চায় কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। একটি সূত্রে জানা যায়, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সরাসরি আইনমন্ত্রীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন রাখেন, ‘আসলে আপনারা (সরকার) জামায়াতে ইসলামীর বিচার চান কি না তা স্পষ্ট করে বলুন। যদি চান তাহলে সেভাবেই কাজ করতে হবে।’ তবে আইনমন্ত্রী এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি।



মন্তব্য চালু নেই