টেকসই উন্নয়নের রূপকল্প অনুমোদন পাচ্ছে মঙ্গলবার

শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়ন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। একই সঙ্গে এতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, হাওর এলাকার উন্নয়ন, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ বেশ কিছু বিষয়ের ওপর।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ভিশন ২০২১ এবং মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া- এই তিন লক্ষ্যের ‘টেকসই উন্নয়নের রূপকল্প’ বলা হচ্ছে প্রণীত এই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে আগামী পাঁচ বছরে।

এরই মধ্যে খসড়ার ওপর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির চূড়ান্ত সভা। আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের (এনইসি) সভায় এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে পুরো পরিকল্পনা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ে পৌঁছানোর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে কিছু মানদণ্ড স্থির করা হয়েছে। সেই মোতাবেক তৈরি করা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।

মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর জন্য মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এতে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিস্থিতি বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক নির্দেশকের যে অগ্রগতি দরকার, তাই করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) নতুন ১ কোটি ৩২ লাখ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। চূড়ান্ত পরিকল্পনায় এই সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১ কোটি ৩২ লাখ। দেশি ও বিদেশি মিলে এ কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া আগামী পাঁচ বছরে দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৮ ভাগ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগে উন্নীত করে মূল্যস্ফীতি ৬ ভাগে আটকানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদি এই উন্নয়ন পরিকল্পনায়।

অর্থবছরভিত্তিক ২০১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য হচ্ছে ৬ দশমিক ৬ ভাগ, ২০১৭ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৮ ভাগ, ২০১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২, ২০১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ ভাগ এবং পরিকল্পনার শেষ অর্থবছরে (২০২০ সালে) প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৮ ভাগে।

পাঁচ বছরে দেশের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ২ ভাগ। অর্থবছরভিত্তিক এ লক্ষ্য হচ্ছে, ২০১৬ অর্থবছরে ৬ ভাগ, ২০১৭ অর্থবছরে ৬ ভাগ, ২০১৮ অর্থবছরে ৬ ভাগ, ২০১৯ অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ এবং ২০২০ অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ ভাগ।

পরিকল্পনাতে অন্যতম প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য প্রায় ১০ শতাংশ কমিয়ে আনা; প্রাথমিক শিক্ষার হার শতভাগ এবং দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার হার ৬০ শতাংশে উন্নীত করা; পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫০ জনে নামিয়ে আনা; জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা; বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা; গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি ব্যয় জিডিপির ১ শতাংশে উন্নীত করা এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বাধ্যতামূলক করা।

এ বিষয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) মো. ড. শামসুল আলম বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দেশের একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা। আলাদাভাবে কোনো অংশকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয় না।

তিনি বলেন, যদিও মোটা দাগে এতে ছয়টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ গঠন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ, আইসিটি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা সংক্রান্ত সেবা রপ্তানিতে সুনির্দিষ্ট নীতিকৌশল প্রণয়ন এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে গতিশীলতা আনয়ন ও রপ্তানির গতিশীলতা বৃদ্ধিতে পণ্যের বৈচিত্রায়ন।

পরিকল্পনা কমিশনের এই সিনিয়র সচিব বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় হাওর এলাকার উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যানের আওতায ১৫৪টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এগুলোতে বন্যা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, স্যানিটেশনসহ হাওর এলাকাগুলোকে পর্যটন এলাকা বানানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া পরিকল্পনায় দুর্যোগ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর একনেক সভা শেষে পরামর্শের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপন করা হয়। খসড়ার প্রাথমিক পর্যালোচনা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ফুড প্রসেসিং, কৃষি যান্ত্রিককরণ, কৃষিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে করণীয় বিষয়টি যেন সুস্পষ্টভাবে পরিকল্পনায় আনা হয়।

কৃষি খাত অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা বাড়াতে আমাদের কৃষিতে নজর দিতে হবে। খাদ্য ঘাটতিতে থাকা যাবে না।’ সামাজিক নিরাপত্তাকে আরো গুরুত্ব দিতে বলেছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক পরিকল্পনা সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। কৃষিভিত্তিক শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পরিকল্পনায়। এ জন্য কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে দেওয়া হবে শুল্কমুক্ত সুবিধা। অর্থাৎ কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণকে সর্বাধিক সুযোগ দিতে পরিকল্পনায় কৃষি প্রক্রিয়াজাত যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানিতে শূন্য কর সুবিধার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বাজেটের সঙ্গে সংগতি রেখে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলকে ১৩টি খাতের আওতায় প্রণয়ন করা হয়েছে।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনকক্ষে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন-সংক্রান্ত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত করার বিষয়ে এটি ছিল চূড়ান্ত সভা। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এনইসি সভায় উত্থাপন করা হবে। আশা করা হচ্ছে, এদিন এটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের চলমান অবস্থার সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানেই এ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এডিপির আকার যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, পরিকল্পনা মোতাবেক সঠিক বাস্তবায়ন হলে দেশের চেহারা বদলে যাবে। প্রণীত রূপকল্পে কোনো বিষয়ই অসংগতিপূর্ণ নয়। তাই বাস্তবায়নও অসম্ভব নয়।

মন্ত্রী আরো বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা।

প্রসঙ্গত, প্রায় দেড় বছর কাজ শেষে তৈরি করা হয় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া। পরে খসড়ার একটি জমা দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যার আলোকে প্রণয়ন করা হয় চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট। মূলত চলমান বাজেটের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার। রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই