টেকনাফ ছুঁয়ে চট্টগ্রামের পথে কোমেন, ৭ নম্বর বিপদ সঙ্কেত

সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূল ছুঁয়ে উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’, যার প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে।

ঝড়ো বাতাসে উপড়ে যাওয়া গাছের চাপায় টেকনাফের সেন্টমার্টিনে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দ্বীপের অর্ধশতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন জানিয়েছেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. শাহ আলম বলেন, এ ঘূর্ণিঝড় আরও পূব-উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে দুপুরের পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

স্থলভাগে ওঠার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে কোমেন স্থল নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে বলে আবহাওয়াবিদদের ধারণা।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বুধবার থেকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৭ এবং মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৫ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখানো হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় কোমেনের অগ্রভাগ বুধবার মধ্যরাতের পর সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূলে আঘাত হেনে ক্রমান্বয়ে উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় কোমেন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম, কক্সবাজার থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২০৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ পূর্ব ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে অবস্থান করছে।

ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

সেই সঙ্গে অতি ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কার কথাও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজার জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক অনুপম সাহা জানিয়েছেন।

কক্সবাজার বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হলেও চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর এখনো চালু আছে।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ফ্লাইট ম্যানেজার উইং কমান্ডার মোহাম্মদ নূরে আলম বলেন, “দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কক্সবাজার বিমাবন্দরে সব ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা আবহাওয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে চারটি ফ্লাইট অবতরণ করেছে।”

বুধবার নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর কক্সবাজারসহ উপকূলীয় এলাকায় সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

ঘূর্ণিঝড় ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে খোলা নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব উল আহসান বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রাত থেকে চট্টগ্রাম জেলা ও আশপাশের এলাকায় টানা বৃষ্টি হচ্ছে। নগরীর অনেক এলাকায় সকাল বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।

রাত থেকে মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ ও বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। এসব এলাকায় লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে রাত থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

এদিকে দুর্যোগময় পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে তৃতীয় মাত্রার সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দরের সদস্য (অ্যাডমিন অ্যান্ড প্ল্যানিং) মোহাম্মদ জাফর আলম।

তিনি বলেন, “জরুরি পরিস্থিতিতে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য বহির্নোঙ্গরে থাকা জাহাজগুলোকে ইঞ্জিন চালূ রাখতে বলা হয়েছে। আর লাইটার জাহাজগুলোকে শাহ আমানত সেতুর দিকে সরে যেতে বলা হয়েছে।”

বন্দরে সীমিত পরিসরে পণ্য খালাস ও বোঝাই চলছে বলে জানান তিনি।

“জেটিগুলোতে যেসব জাহাজের নিজস্ব ক্রেন আছে, তারা পণ্য ওঠানামা করলেও রাত ২টার পর থেকে বন্দরের ক্রেনগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।”

সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় ঢাকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) বাস্তবায়ন বোর্ডও জরুরি বৈঠকে বসে বলে মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি গবাদি পশুর নিরাপদ স্থানের ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে জনগণকে স্থানান্তর, বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণ, মেডিকেল টিম ও হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয় ওই বৈঠক থেকে।

জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকদের সম্ভাব্য যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে সম্ভাব্য ভূমিধসের বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বলেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও সিপিপির সদর দপ্তর সার্বক্ষণিক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি।

লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার মেঘনা উপকূলবর্তী এলাকায় লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে সন্ধ্যায়ই মাইকিং শুরু হয় বলে জেলা প্রতিনিধি জানিয়েছেন।



মন্তব্য চালু নেই