গণতন্ত্রের বিজয় বনাম কালো দিবস :

টার্গেট ৫ জানুয়ারি : মাঠে থাকবে কে?

গতবছর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে যেমন সারাদেশ ছিল উত্তপ্ত, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে আবারো উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতির মাঠ। এ দিনটিতে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতার প্রথম বর্ষপূর্তি। সে জন্য তারা দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে রাজপথের বিরোধী শক্তি বিএনপি জোট এ দিনকে ‘গণতন্ত্রের কালো দিবস’ পালন করবে। ইতোমধ্যে এ দিনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলছেন।

যদিও ৫ জানুয়ারির আন্দোলন নিয়ে অনেকটাই অংক কষে ফেলেছে বিএনপি জোট। আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। তাই বিএনপিকে ওইদিন সমাবেশ করার অনুমতি নাও দেয়া হতে পারে। সে জন্য ২ জানুয়ারি ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করা হবে। দু’চার দিনের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী বা পল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে চিঠিও দেয়া হবে। তবে সমাবেশের অনুমতি না মিললে টানা ৭২ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা করা হবে। সেই হরতাল ৪ জানুয়ারি শুরু হয়ে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। যাতে করে ৫ জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ যেনো তেমন সাড়া না পায়। কারণ হরতাল মানেই আতঙ্ক, সেইদিন মানুষ ঘর থেকে তেমন বের হবে না। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জানুয়ারি মাসকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিচ্ছে বিশেষ প্রস্তুতি।

বিরোধীদলহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে মূলত টার্গেটে পরিণত হয়েছে ৫ জানুয়ারি। ওই দিনটিকে কালো দিবস আখ্যা দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ঢাকা অচল করে সরকারকে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে জোর তৎপরতা শুরু করেছে। আবার ঢাকাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলও দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ নাম দিয়ে পাল্টা অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে। দলগুলোর সহযোগী সংগঠন ও অঙ্গসংগঠনকে এবং জেলা কমিটিগুলোকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন দিক নির্দেশনাও।

দেশের সাধারণ জনগণের মনে এখন একটাই প্রশ্ন কী ঘটতে যাচ্ছে ৫ জানুয়ারি। ওই দিন কি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ না ‘গণতন্ত্রের কালো দিবস’ পালন হবে, নাকি অতীতের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর ফাঁকা আওয়াজে পরিণত হবে।

আওয়ামী লীগের কাছে দুই কারণে আগামী জানুয়ারি মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি, অন্যদিক নতুন বছরের সূচনা। ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে মহানগর ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠক করা হয়। বৈঠকে ঢাকায় বিএনপি-জামায়াত যাতে কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য সব ধরনের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া সরকারবিরোধী যে কোনো তৎপরতা নস্যাৎ করতে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াতের নেতারা যাতে মাঠে নামতে না পারে সেজন্য পুরনো মামলা নতুন করে সচল করে গ্রেপ্তার ও নতুন নতুন মামলায় জড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। ইতিমধ্যে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নামের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই তালিকা অনুযায়ী আগামী সপ্তাহে ধরপাকড় শুরু করা হতে পারে।

পাশাপাশি আগামী ৫ জানুয়ারি সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক বছরের সাফল্যগুলো তুলে ধরতে ১ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ক্ষমতাসীন দল মাঠে থাকবে। এ সপ্তাহেই ঘোষণা করা হবে মাসব্যাপী কর্মসূচি। সরকারের এক বছরের সাফল্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে বিশেষ করে রাজধানীতে নেয়া হবে সংসদীয় আসনভিত্তিক সিরিজ কর্মসূচি। সরকারের উন্নয়ন প্রচার করতে করা হচ্ছে ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড।

এছাড়াও দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে বড় ধরনের শোডাউন করা হবে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন ছাড়াও ১৪ দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও এতে অংশ নেবেন। ৫ জানুয়ারিও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের এক বছরের সাফল্য প্রচার করা হবে। ওইদিন রাজধানীতে করা হবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। পাশাপাশি ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ।

বিরোধীদের আন্দোলন থেকে জনসাধারণের নজর ফেরাতে বিভিন্ন খাতে বিগত ও বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও সফলতা তুলে ধরার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল। এ জন্য আগামী ১৫ থেকে ২২ জানুয়ারি মহানগর, জেলা ও উপজেলায় সমাবেশ করবে ক্ষমতাসীনরা। গত ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর ধানমণ্ডির কার্যালয়ে ১৪ দলের জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রসঙ্গে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘৫ জানুয়ারি সরকারের দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ ও ১০ জানুয়ারি জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করা হবে। এসব কর্মসূচি সফল করতে মহানগর ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছি।’

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ বলেন, ‘জামায়াত-বিএনপির নৈরাজ্য কঠোর হাতে দমন করার জন্য কেন্দ্র থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। প্রতিটি ওয়ার্ড নেতাদের এ বিষয়ে সতর্কও করেছি।’

অন্যদিকে নতুন নির্বাচনের দাবিতে ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অত্যন্ত গোপনীয়তায় আন্দোলনের ছকও তৈরি করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ২ জানুয়ারি ঢাকায় জনসভা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। আর জনসভার অনুমতি না দেয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে টানা ৭২ ঘণ্টা হরতাল কর্মসূচি আসতে পারে। এরপর থেকে টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতেই থাকবে বিএনপি জোট। দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহল থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই বিএনপি আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে বলেও বিএনপি ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

সরকার পতনের আন্দোলন ঠিক করতে সোমবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর ২০ দলের এক বৈঠক হয়। বৈঠকে সরকার পতনের আগামী আন্দোলনে ২০ দল যেন একজোট হয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে সে জন্য ঢাকা মহানগরীর থানায় থানায় লিয়াজোঁ করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হবে। বৈঠকে সব দলের করনীয় সম্পর্কে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এছাড়া খুব শিগগিরই আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় সে বৈঠকে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘৫ জানুয়ারির আগেই সরকারের উচিৎ আমাদের দাবি মেনে নেয়া। কিন্তু সরকার সে দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। তাই দল ও জোট ৫ জানুয়ারির আগেই আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যে কোনো জনসভা থেকেই চেয়ারপারসন এই কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। ২৭ তারিখে গাজীপুরে জনসভা করতে না দিলে সেদিন থেকেই আন্দোলনের শুরু হবে।’

আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা উড়িয়ে দিয়ে বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, ‘এবারের আন্দোলন কর্মসূচি হবে অত্যন্ত কঠোর। এ অবৈধ সরকারকে হঠাতে যেমন কর্মসূচি দেয়া দরকার তেমন কর্মসূচিই দেয়া হবে।’

তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘আন্দোলনের নামে সহিংসতা করলে বিএনপির খবর আছে। আওয়ামী লীগকে হুমকি দিয়ে ক্ষমতা থেকে নামানো যাবে না। জানুয়ারিতে তাদের টিকিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগই রাজপথে থাকবে।’



মন্তব্য চালু নেই