টার্গেট পহেলা বৈশাখ: চলছে জাটকা আহরণ-মজুদ-বিক্রি

দুয়ারে কড়া নাড়ছে পহেলা বৈশাখ। বাঙালীয়ানার ষোলআনা পূর্ণ করতে পহেলা বৈশাখ মানেই পান্তা ইলিশ। কিন্তু সাগরে চলছে ইলিশের আকাল। তাতে কি! বড় ইলিশ জালে না আটকালেও ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে জাটকা ইলিশ। সরকারীভাবে জাটকা নিধনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে বেপরোয়াভাবে চলছে জাটকা নিধন।

একদিকে মনিটরিং দুর্বলতা, অপরদিকে পহেলা বৈশাখ এ দু`মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগিয়ে জেলেদের অগ্রিম টাকা দিয়ে মুনাফা লোভি ব্যবসায়ীরাও ব্যাপকহারে মজুদ করছে এসব জাটকা।

সূত্রে জানা গেছে, পহেলা বৈশাখকে টার্গেট করে কক্সবাজারের মৎস্য ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে মজুদ করছে জাটকা ইলিশ। তীরে ব্যবসায়ীদের কাছে জাটকার চাহিদা থাকায় জেলেরাও ব্যস্ত জাটকা নিধনে। সরকারের পক্ষ থেকে নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা নিধনের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা জেলেদের দাদন দিয়ে জাটকা সংগ্রহ করছেন।

জাটকা সংরক্ষণ সময়ে জেলেদের সরকারীভাবে খাদ্য সহায়তা দেয়ার কর্মসূচি থাকলেও কক্সবাজারের জেলেদের ভাগ্যে তা জোটেনি এখনো। এছাড়া জাটকা সংরক্ষণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন অধিদফতরের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও এখনো কক্সবাজারে দৃশ্যমান কোনো অভিযান হয়নি। একদিকে খাবারের অভাব অপরদিকে চাহিদার কথা বিবেচনা করে অন্য মাছের চেয়ে জাটকাতেই বেশি ঝুঁকছেন জেলেরা।

গত কয়েকদিনে সরেজমিনে নুনিয়াছড়াস্থ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কূলে ভিড়েই জেলেরা ফিশিং বোট থেকে প্রকাশ্যে খালাস করছে জাটকা ইলিশ। তাতেই দৌড়ঝাঁপ ব্যবসায়ীদের। চড়া দামে ক্রয় করে দ্রুত প্যাকেজিংয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে সাগর থেকে আনা মাছ। পরে অবতরণ কেন্দ্রের শ্রমিকরা সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ফ্রিজিংয়ের জন্য কোল্ডস্টোরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এসব জাটকা ইলিশ বিক্রয় এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়া খোদ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপকের সামনেই হচ্ছে। এমনকি জাটকা ধরতে জেলে ও ব্যবসায়ীদের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক নিজেই উৎসাহ যোগান বলে অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সাংবাদিকের ক্যামরা দেখেই নিজেকে আড়াল করেন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মিজান নামের এক জাটকা ইলিশ ব্যবসায়ী। এসময় জাটকা ইলিশের স্তুপের ছবি তুলতে তিনি বাধা দেন।

এক পর্যায়ে তিনি বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে সাগরে খুব কম মাছ পাওয়া যাচ্ছে। তবে জেলেদের জালে কিছুটা জাটকা ইলিশ মিলছে। এছাড়া ইলিশ পাওয়া না যাওয়ায় পহেলা বৈশাখে জাটকা ইলিশের কদর থাকবে বেশি। তাই আড়তদাররা এখন থেকেই ব্যাপক হারে এসব মাছ মজুদ করছে।

জাটকা নিধনের বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম কিছুটা ক্ষেপেই যান। তবে অবতরণ কেন্দ্রে কোনো জাটকা ইলিশ বিক্রি হয়না দাবি করে তিনি বলেন, এমনিতেই ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে সাগরে মাছ মিলছে না। সেখানে জেলেরা জাটকা পাবে কোথায়।

অথচ ব্যবস্থাপকের চোখের সামনেই বিক্রি হয়েছে জাটকা ইলিশ। পরে জাটকা সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

কক্সবাজার জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, পহেলা নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস সময়ে জাটকা ইলিশগুলো পর্যাপ্ত ইলিশে পরিণত হয়। তাই সরকারীভাবে এই ৮ মাস সময়ের মধ্যে বিক্রয়, মজুদ ও পরিবহন আইন অমান্যকারীকে কমপক্ষে ১ বছর, সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, পাচঁ হাজার টাকা জরিমানা ও উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়া যে সময়টিতে জেলেরা জাটকা আহরণ থেকে বিরত থাকবে সে সময়ে মৎস্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে প্রতিজন জেলেকে মাসে ৪০ কেজি চাউল দেয়ার কর্মসূচি রয়েছে।

আবু ছিদ্দিক নামে একজন জেলে বলেন, গত এক মাসের বেশি সময় ধরে সাগরে মাছ ধরা পড়ছে খুবই কম। অনেকে মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে আসে। তবে জালে মাঝে মধ্যে জাটকা ধরা পড়ে। জাটকা ধরা পড়লেও কোস্টগার্ডের ঝামেলায় পড়তে হয়। ঘুষ দিতে হয় সবাইকে। একারণে অনেকে এখন সাগরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া জাটকা সংরক্ষণ সময়ে সরকারী চাল পাওয়ার কথা থাকলেও কোনো দিন তারা তা চোখেই দেখেননি।

বেশ কয়েকজন সচেতন ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। আসলে মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি নেই। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রেও ব্যবস্থাপকের সামনে নিয়মিত জাটকা বিকিকিনি চলছে। এছাড়া সাধারণ জেলেদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য তেমন কোনো কর্মসূচিও দেখা যায়না। যার কারণে প্রতিনিয়ত জাটকা নিধন চলছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদাসিন মনোভাব ত্যাগ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তারা।

প্রতিনিয়ত জাটকা নিধনের বিষয়টি স্বীকার করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন বলেন, কক্সবাজারে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র রয়েছে শুধুমাত্র একটি। সেখানে যথাযথ মনিটরিং করা হয়। কিন্তু কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগরের বিশাল তীর। স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে এই সীমানায় নিয়মিত তদারকি সহজ নয়। এ কারণে সাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে জেলেরা চুরি করে জাটকা তীরে নিয়ে আসছে।

তিনি বলেন, কক্সবাজারে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। জাটকা সংরক্ষণ সময়ে প্রতিজন জেলেকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেয়ার কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু অধিদফতরের শর্তের কারণে কক্সবাজারের জেলেরা সরকারি এই খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অধিদপ্তরের শর্তে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব জেলেরা শুধুমাত্র জাটকা আহরণের উপর নির্ভরশীল তারাই সরকারি খাদ্য সহায়তা পাবে। কিন্তু কক্সবাজারের জেলেরা সাগরে জাটকা না ধরলেও স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য মাছ ধরা পড়ে তাদের জালে। এই মূহুর্তে চাঁদপূরের পদ্মায় জাল ফেললেই জাটকা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবেনা। কিন্তু কক্সবাজারের বঙ্গোপসাগর সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।



মন্তব্য চালু নেই