জিয়া-মুসা-চকলেটসহ ১২ জঙ্গি এখনো অধরা

মারজান নিহত হওয়ার পর এখনও সক্রিয় এমন আরও তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে ধরার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন গোয়েন্দারা। এবিটির সমন্বয়ক ও সামরিক কমান্ডার চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, নব্য জেএমবির অন্যতম সংগঠক মইনুল ইসলাম ওরফে আবু মুসা ও বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটকে গ্রেপ্তারে চলছে বিভিন্ন ইউনিটের টানা অভিযান।

ছয় মাস ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জঙ্গিবাদ। আর সেই ‘ব্যথা নির্মূলে’ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জঙ্গি আস্তানায় হানা দিচ্ছে তারা। গুলশান হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে তানভীর কাদেরী, তামিম চৌধুরী ও মেজর জাহিদ, নুরুল ইসলাম মারজানসহ ৪০ জঙ্গি নিহত হয়েছেন র‌্যাব ও পুলিশের হাতে। তাদের মধ্যে আছেন মোস্ট ওয়ান্টেড ১৩ জঙ্গি।

এখনো ভয়ংকর কিছু জঙ্গি আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে শীর্ষ জঙ্গি নেতা নুরুল ইসলাম মারজান ও সাদ্দাম হোসেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর অনেকটাই স্বস্তি ফিরেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে।

একে একে নেতৃস্থানীয় জঙ্গিদের গ্রেপ্তার ও বিভিন্ন অভিযানে নিহতের পর সফলতার একেকটি ধাপ পেরুচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নবগঠিত শাখা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিইউ)। গত ৬ মাসে বেশ কয়েকটি বড় ও সফল জঙ্গি অভিযান সম্পন্ন করেছে সিটিইউ। পুলিশি অভিযানে বা বন্দুকযুদ্ধে বড় সব জঙ্গির পতন হয়েছে। একের পর এক দুর্ধর্ষ সব জঙ্গি নিহত হলেও এখনো মাথা ব্যথার কারণ হয়ে আছে নব্য জেএমবির আরো অন্তত ১২ জঙ্গি। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী জঙ্গিও রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও গোয়েন্দা তৎপরতায় ওই ১২ জনকে চিহ্নিত করা গেলেও তাদের নাগালই পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চিহ্নিত জঙ্গিদের মধ্যে অন্তত দুজন অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন। পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে এই মুহূর্তে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আছেন সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জিয়া ও আরেক ভয়ংকর জঙ্গি আবু মুসা। দীর্ঘদিন ধরে এ দুজনকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের টপমোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টের প্রথমদিকেই রয়েছে এ দুই জঙ্গির নাম।

কাক্সিক্ষত এ দুজনকে ধরতে পারলে জঙ্গি দমনে বড় ধরনের সাফল্য দাবি করতে পারবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। জঙ্গি দমনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, পলাতক এসব জঙ্গিই নিঃশেষের পথে থাকা জেএমবিকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। তাদের আইনের আওতায় নেওয়া গেলে ভয়ংকর এ সংগঠনটিকে আপাতত নির্মূল করা সম্ভব হবে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, পলাতক ধরতে হন্যে হয়ে খুঁজছে সিটিইউ। তাদের আইনের আওতায় নিতে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৬ মাসে নব্য জেএমবির প্রথম সারির নেতা থেকে শুরু করে অপারেশনাল ইউনিটের দুর্ধর্ষ অন্তত ৪০ জঙ্গি নিহত হয়েছেন। তবে গত অক্টোবরে গাজীপুরের পাতারটেকে জঙ্গি আস্তানায় নিহতদের মধ্যে ইব্রাহীম (১৯) নামে এক জঙ্গি রয়েছেন।

সে গত ৮ আগস্ট পুরান ঢাকার বাসা ছেড়ে ‘হিজরতে’ বের হন। আবার গত ৫ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে নিহত সাদ্দাম বেশ কয়েকদিন আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হন। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি। এ থেকে মনে হচ্ছে, অভিযানের মধ্যেও পালিয়ে থাকা দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা কর্মী সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, পলাতক ১২ জঙ্গির মধ্যে মেজর জিয়া ও আবু মুসা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। নব্য জেএমবির এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারাই। পলাতক দুর্ধর্ষ জঙ্গির মধ্যে খালিদ ও রিপন ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া ইকবাল গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের অভিযানের সময় ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যান।

মানিক, মামুন, জোনায়েদ খান, আজাদুল কবিরাজ ও বাদল নব্য জেএমবিতে ‘বড় ভাই’ হিসেবে চিহ্নিত। নব্য জেএমবির কার্যক্রম পুরোপুরি নির্মূলে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল নুরুল ইসলাম মারজান। তাই মারজান নিহত হওয়ার পর গোয়েন্দাদের দৃষ্টি এখন মেজর জিয়া, আবু মুসা, বাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার ওরফে চকলেট এবং জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে শুভাষ। এ চারজন সংগঠনে দুর্ধর্ষ হিসেবে চিহ্নিত এবং নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করা গেলেই নব্য জেএমবিকে আপাতত নির্মূল করা সম্ভব হবে। ওই তিনজন ছাড়াও ইকবাল, রিপন, খালিদ, মানিক, মামুন, জোনায়েদ খান, আজাদুল কবিরাজ ও বাদল পালিয়ে থেকে নব্য জেএমবিকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।

এদিকে আজিমপুরে অভিযানের পর আহতাবস্থায় গ্রেপ্তার তিন নারী জঙ্গির কাছ থেকে সংগঠনটির নারী শাখার বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। নারী শাখার জঙ্গিরা আত্মঘাতী হতেও দ্বিধা করেন না। তারা যে কতটা ভয়ংকর আত্মঘাতী, তা আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় কাউন্টার টেররিজমের অভিযানেই প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। নব্য জেএমবির নিহত জঙ্গিদের স্ত্রী এবং নারী স্বজনদের নিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও গত ২৪ ডিসেম্বর নিহত আরেক জঙ্গি নেতা মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও আবু মুসার স্ত্রী তৃষা মনি রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানা থেকে আত্মসমর্পণ করেন। ওই ঘটনায় শাকিরা নামে এক নারী ও কিশোর জঙ্গি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন।

গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নব্য জেএমবির হিংস্রতার পরই নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর শুরু হয় টানা অভিযান। হলি আর্টিজান হামলার সময়ে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি। এরপর ২৪ দিনের মধ্যেই কল্যাণপুরে বিশেষ অভিযানে নিহত হন আরো ৯ জঙ্গি। অবশ্য শোলাকিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে ঘটনাস্থলে এক জঙ্গি ও আটকের পর পালাতে গিয়ে নিহত হন অপর জঙ্গি। গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে নিহত হন সংগঠনটির মূলহোতা তামিম চৌধুরীসহ তার দুই দেহরক্ষী। গত ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরে অভিযানে নব্য জেএমবির অপারেশনাল কমান্ডার মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম নিহত হন। এর কয়েকদিন পর ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে নিহত হন অন্যতম সংগঠক তানভীর কাদেরী ওরফে আবদুল করিম। আর গত ৯ অক্টোবর গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ায় নিহত হন নব্য জেএমবির ১২ জঙ্গি। সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন আরেক শীর্ষ জঙ্গি নেতা নুরুল ইসলাম মারজান ও উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান জাহিদ হোসেন।

এবার গোয়েন্দাদের টার্গেটে মেজর জিয়া ও মুসা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারীদের মূলহোতা এই মেজর জিয়া। জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। ৫ বছর ধরে তিনি পলাতক। পলাতক থেকে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। রাজধানীসহ বিভিন্ন সময় টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত গ্রেফতারকৃত কয়েক জঙ্গির দেওয়া তথ্যে প্রথম উঠে আসে মেজর জিয়ার নাম। এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। নব্য জেএমবির সঙ্গেও মেজর জিয়ার যোগাযোগ রয়েছে।

২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাসদর দপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীর সাবেক ও তৎকালীন কিছু সদস্য দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে মেজর জিয়া অন্যতম। মেজর জিয়া জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন বলে সেনাসদর দফতর জানিয়েছিল। এই অভ্যুত্থান চেষ্টার পেছনে ইশরাক আহমেদ নামে তার এক প্রবাসী বন্ধু জড়িত ছিল।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, ৯টি টার্গেট কিলিংয়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এই মেজর জিয়া। ২০১৩-১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দুজনকে হত্যা করে এবিটি। ওই সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হত্যার পেছনেও এবিটি জড়িত। এসব ঘটনার তদন্ত শেষে মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসেবে নাম উঠে আসে জিয়ার। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুজনকে হত্যা করে এবিটির সিপার সেল। মান্নান ও মাহবুব দুজনই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। এর আগে ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করেন জঙ্গিরা। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন জিয়ার অনুসারীরা। তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চট্টপাধ্যায় ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরের শেষের দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।

গুলশান হামলায় জড়িত ১৩ জঙ্গি নিহত : গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, এমন ১৭ জঙ্গিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাদের মধ্যে ১৩ জন গত ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে নিহত হন নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। একজন কারাগারে। বাকি তিনজন হলেন রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও সাগর। রাজীব ও বাশারুজ্জামানকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলেও আশাবাদী পুলিশের সিটি ইউনিট। চিহ্নিত এই ১৭ জনের মধ্যে পাঁচজন গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেন। বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র-বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন। পুলিশ বলছে, তারা সবাই ‘নব্য জেএমবি’র সঙ্গে যুক্ত।



মন্তব্য চালু নেই