জামায়াতের ‘অর্থমন্ত্রী’র কবর

নামের সঙ্গে ’মীর’ থাকার কারণে কেউ কেউ মীর জাফরও ডাকতেন। কেউ বলতেন টাকার কুমির, আবার কেউবা বলতেন টাকার কুমির ‘জগৎশেঠ’। সেই ‘মীরজাফর, টাকার কুমীর, জগৎশেঠ’ মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে কেবল একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হল না। বড় রকমের হোঁচট খেল জামায়াতে ইসলামীও। যা এর আগে ফাঁসি কার্যকর হওয়া অন্য নেতাদের হারানোর চেয়েও দলটির কাছে বেশি কিছু।খবর পরিবর্তনের।

মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে আপাতত জামায়াতে ইসলামীর টাকার পাহাড়ও যেন গুঁড়িয়ে গেল। মানবতাবিরোধী অপরাধের আর একটি কালো দাগ জাতির গা থেকে মুছে যাওয়ার পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক দলটির টাকা যোগানের পথও মুখ থুবড়ে পড়ল!

মীর কাসেম আলী গ্রেফতারের পর থেকেই জামায়াতের টাকার স্রোতে ভাটা পড়েছিল।

জা্মায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা পয়সার মালিক মীর কাসেম আলী, দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য। শুধু টাকার জোরে জামায়াতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হত কাসেমের ইচ্ছায়। নামে বেনামে যার রয়েছে শতশত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় ১৯৮০ সালে মীর কাসেম রাবেতা আল ইসলামীর এ দেশীয় পরিচালক হন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর টাকায় আস্তে আস্তে গড়ে তোলেন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের আয় ও কর্মসংস্থানের বড় উৎস হয়ে দাঁড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান। যেখানে কাজ করেন জামায়াত শিবিরের হাজার হাজার কর্মী। জামায়াত করা ছাড়া কাসেমের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সহজে কাউকে চাকুরি দেওয়া হত না।

ব্যাংক, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা সব খাতেই ছিল তার দাপুটে ব্যবসা। তিনি ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্য ছিলেন তিনি। এই ট্রাস্টের আটটি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও ইমেজিং সেন্টার, একটি মেডিকেল কলেজ, একটি নার্সিং কলেজ ও একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক স্কুল ও কলেজ এবং দিগন্ত পেপার মিলের মালিক ছিলেন কাসেম আলী। তিনি ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট (এআইটি) ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনেরও চেয়ারম্যান ছিলেন মীর কাসেম আলী। এর অধীনে রয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকা। ছিল দিগন্ত টেলিভিশন। এ ছাড়া মীর কাসেম আলীর ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক গ্রুপের নাম ‘কেয়ারী’। তিনি ছিলেন কেয়ারী হাউজিং ও ইডেন শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান। নামের আগে ‘কেয়ারী’ রয়েছে এ রকম ১০টি কোম্পানির পরিচালক ছিলেন মীর কাসেম আলী। এগুলো হল- কেয়ারী লিমিটেড, কেয়ারী পোলট্রি হ্যাচারি অ্যান্ড প্রসেস, কেয়ারী স্প্রিং, কেয়ারী শান, কেয়ারী ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিসেস, কেয়ারী তাজ, কেয়ারী কালার সেন্টার, কেয়ারী ঝর্ণা, কেয়ারী রিয়েল এস্টেট ও কেয়ারী টেলিকম লিমিটেড।

কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য কাসেম আলী একক মালিকানায় বিলাসবহুল পাঁচটি প্রমোদতরি তৈরি করেছিলেন, এগুলো হল- কেয়ারী ক্রুইজ, কেয়ারী ডাইন, কেয়ারী সিন্দবাদ, কেয়ারী কর্ণফুলী ও কেয়ারী তরঙ্গ। এ ছাড়া কেয়ারী গ্রুপের সহস্রাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ও বিপণি বিতান রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে।

মানবতাবিরোধী বিচারের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে মীর কাসেম আলী বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে ইউরোপ-আমেরিকায় লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন। তারই লবিংয়ে হাউস অব কমন্সের শক্তিশালী একটি লবিস্ট গ্রুপ কাজ শুরু করে এবং তারা যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকে। মীর কাসেম আলীর ভাই মীর মাসুম আলী ও জামায়াত নেতা আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাকীবুর রহমান নিজামীর তত্ত্বাবধানে ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ ও ‘হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ চালাতে শুরু করে নানা প্রচারণা। ‘ক্লোয়াক্রম অ্যাডভাইজর’ ও ‘কে গ্লোবাল’ নামে দুটি লবিং প্রতিষ্ঠানও সাবকন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে তাদের সঙ্গে।

এর আগে জামায়াতের ফাঁসি কার্যকর হওয়া অন্য নেতারা কেউ আধ্যাত্মিক বা রাজনৈতিক কূটকৌশলে পারদর্শী ছিলেন। আর মীর কাসেমের মিশন ছিল দেশ-বিদেশে টাকা দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে চাঙ্গা রাখা। তাই কেউ কেউ তাকে জামায়াতের ‘অর্থমন্ত্রী’ও বলতেন।

এতো কিছুর পরও হাজার হাজার কোটি টাকা আর টাকার দম্ভ তার শেষ রক্ষা করতে পারল না।



মন্তব্য চালু নেই