জাতীয় সংসদে সুবাতাস

দাঙ্গা হাঙ্গামা, বুলেট, রক্ত ঝরাঝরি, প্রাণহানি, স্বজন হারানোর কান্না আর বিপুল আর্থিক ক্ষতির মধ্যেই গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

কেমন হবে এই সংসদ- তা নিয়ে শুধু দেশ নয়, বিদেশবিভূঁইয়ে ছিল নানা উৎকণ্ঠ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে চলে গেল একটি বছর। জাতীয় সংসদে বইছে সুবাতাস। কোথাও কোনো ছন্দপতনের চিহ্ন নেই।

গত ২৯ জানুয়ারি দশম সংসদ অধিবেশন বসার পরপরই প্রায় স্থিতিশীল হয়ে যায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর পাল্টে যেতে থাকে সংসদের চালচিত্র।

কেমন ছিল সংসদ : গেল এক বছরে আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্ঝঞ্জাট কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এর আগের সংসদ অধিবেশনগুলোতে যেভাবে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে অকথ্য খিস্তি খেউর বা গালিগালাজ বা ভাষার বিকৃত ব্যবহার হয়েছে এবার তার ছিটে ফোটাও ছিল না। সরকার জনগুরুত্বপূর্ণ বিলগুলো বিরোধী দলের কোন কঠোর বিরোধীতা ছাড়াই অনায়াসে পাশ করিয়েছে। সংসদ অধিবেশনের ৮৩ কার্যদিবসের প্রতিটি দিবসই ছিল প্রাণবন্ত। সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। সরকারি দলকে কখনোই কোরাম সংকটে পড়তে হয়নি। বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারি দলের বোঝাপড়া ছিল চোখে পড়ার মতো।

প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ বেশিরভাগ কার্যদিবসে উপস্থিত থাকায় সংসদ ছিল অনেকটাই কার্যকর।

বিরোধী দলের ভূমিকা : দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোন বিরোধী দল সরকারকে পূর্ণ সহায়তা দেওয়ার মতো মানসিকতা পোষণ করেছে। ৯০’র গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দোর্দ- প্রতাপে নয় ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। স্বৈরাচারী হিসেবে আখ্যা পাওয়া সাবেক রাষ্ট্রপতির দল জাতীয় পার্টি এবারই প্রথম বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে সংসদে। আছে মন্ত্রী পরিষদেও। এই দ্বৈতনীতির ফলে তাদের ভূমিকা অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও দেশের উন্নয়নে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য বিরোধী দল প্রশংসিত।

‘বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা নয়, উন্নয়নে সরকারকে সহযোগিতা’ এই মতাদর্শই বেছে নিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ। যে কারণে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা এবং উন্নয়ন বিলগুলোতে সমর্থন দিয়েছে জাতীয় পার্টি।

গত একবছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে একবার মাত্র ওয়াক আউট করে বিরোধী দল।

আগের বিরোধীদলগুলোর মতো এবার বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা সংসদে অনুপস্থিত থাকছেন না। সংসদকে কার্যকর করতে বিরোধী দলের বেশিরভাগ সংসদ সদস্য সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকছেন। এছাড়া বিরোধী দলের কথায় ঝাঁঝ থাকলেও বিশ্রি শব্দের কোন ব্যবহার ছিল না।

দশম সংসদের এক বছরে ভাষার সুন্দর ব্যবহার এবং শালীনতা দুই বজায় রেখেছে বিরোধী দল।

‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ বলে কোন কোন রাজনৈতিক দল সমালোচনা করলেও সংসদীয় কার্যক্রমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জাতীয় পার্টি। এমনটাই মনে করেন সংসদীয় গণতন্ত্রের বিশ্লেষকরা।

বিতর্কিত মন্ত্রী : দশম সংসদের এক বছরে সরকারকে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছেন তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে ধর্ম নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে এখন জেলে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রে টাঙ্গাইল সমিতির সভায় তিনি মহানবী (স.), হজ ও তাবলীগ জামায়াত নিয়ে কটুক্তি করেন।

তীব্র জনরোষ সৃষ্টি হয় তাকে নিয়ে। যে কারণে মন্ত্রীত্ব এবং আওয়ামী লীগের দলীয় সব ধরনের পদ হারাতে হয়েছে তাকে। যায় যায় করে টিকে আছে তার সংসদ সদস্য পদ।

সরব সাংসদ : দশম সংসদের চারটি অধিবেশনে সবচেয়ে বেশি সরব সাংসদ হিসেবে যার উপস্থিতি ছিল তিনি হচ্ছেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। তিনি যেমন নিজে কথা বলে হাসিয়েছেন সংসদ সদস্যদের, তেমনি অনেকের কথায় হেসেছেন। বিল, ৭৪ বিধিতে নোটিশ এবং পয়েন্ট অব অর্ডারে তার বক্তব্য হয়ে উঠেছিল সংবাদের উপজীব্য।

উল্লেখযোগ্য বিল : দশম সংসদে এক বছরে চারটি অধিবেশন হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি শুরু হয়ে নিয়মিত বিরতিতে চারটি অধিবেশনের কার্যক্রম শেষ হয় ৩০ নভেম্বর। মোট ৮৩ কার্যদিবস বসেছে সংসদ অধিবেশন। এরই মধ্যে বিল পাশ হেেছ ১৯টি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সংবিধানের ষোড়শ (সংশোধনী) বিল-২০১৪। যা বিচারকদের অভিসংশন বিল হিসেবেও খ্যাত।

এছাড়া সাংবাদিকদের কল্যাণে প্রণীত সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট বিলটিও উল্লেখযোগ্য।

সংসদে বিএনপির উপস্থিতি : গেল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সংসদে ভূমিকা রাখার সব রকম অধিকার হারায় নবম সংসদের বিরোধী দল বিএনপি। তবে এই দলের কারও শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও ঘুরে ফিরে বিএনপির নাম উচ্চারিত হয়েছে সারা বছর জুড়ে। এমন কোন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য নেই যে, যিনি তার বক্তব্যে একবারের জন্যও বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার নাম নেননি। এমনকি শব্দ পরিসংখ্যান করলে এই দলটি এবং বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নাম প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে পাওয়া যাবে।

অনেক সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীও অজ্ঞাতে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকেই আখ্যায়িত করেছেন, আবার ভুলও সংশোধন করেছেন। অর্থাৎ বছর জুড়ে সংসদে যে আলোচনা হয়েছে তারই একটি অংশে পরিণত হয়েছিল বিএনপি। না থেকেও সংসদে ছিল দলটি।

সংসদের বাইরে থেকেও বিএনপির মুখে ছিল সংসদের কীর্তিগাঁথা। তারা সরকারকে যেমন অবৈধ আখ্যা দিয়েছে তেমনি বিরোধী দলকে বলেছে গৃহপালিত বিরোধী দল। আর সেই সমালোচনা করতে গিয়েই এই বিএনপি নেতারা প্রতিনিয়ত মনে করেছে সংসদকে।

সব মিলিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় এই সংসদ যে একটি পরিচ্ছন্ন অবস্থান তৈরি করেছে তার প্রশংসা করেছে সারা বিশ্ব। যার উপহার হচ্ছে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন (সিপিএ) এবং ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) মতো দুটি আন্তর্জাতিক সংসদীয় সংগঠনে দশম সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রেসিডেন্ট পদে বিজয় লাভ।

এছাড়া এই সংসদের বড় চমক হচ্ছে এর স্পিকার, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেতা তিন জনই নারী। যা গৌরবের। বিশ্বে একই সময়ে ক্ষমতায় থাকার এই সমীকরণ বিরল।



মন্তব্য চালু নেই