নেট পাটায় ছেয়ে গেছে সাতক্ষীরার তালার শালিখা নদী

জলাবদ্ধতার আশংকায় বেতনা পাড়ের ১২ লক্ষ মানুষ

ষড়ঋতুর রঙিন রঙ্গমঞ্চে এখন বর্ষাকাল। অঝর ধারায় নিঝুম বৃষ্টি এখনো ঝরেনি। ভারি বর্ষনও এবছর এখনো পর্যন্ত হয়নি। যে টুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে তা ফোটাই বলা যায়। আর এ ছিটে ফোটা বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে সাতক্ষীরার তালা, আশাশুনি ও সদর উপজেলায়। মুষলধারে ভারি বর্ষন হলে জলবদ্ধতা প্লাবনে রূপ নিবে। এমনটি আশংকা করছেন জলাবদ্ধ এলাকার কৃষকরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দলুয়া, বাগডাঙ্গা, কুলপোতা, সোনা বাঁধাল, হরিনখোলা দলুয়া তালতলা আশাশুনি উপজেলার মহিষা ডাঙ্গা, দাদপুর, সদর উপজেলার গোয়ালপোতা শাল্যে, দৌলতপুর, কাশিনাথপুর রুদ্রপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এসব এলাকার বিলগুলো পানিতে ডুবে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে আমন ধানের বীজতলা। বিলের পানি বাড়ির উঠোন ছুঁই ছুঁই করছে। আবারো ঘরবাড়ি ছেড়ে হয়তো চলে যেতে হবে উচু রাস্তার উপর। অথবা অন্য কোথাও। হাজার হাজার বিঘা জমির ফসল সর্বনাশা জলাবদ্ধতা গ্রাস করবে। শতশত শিক্ষার্থীর লেখাপড়া থমকে যাবে। লণ্ডলণ্ড হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত গোটা এলাকা। এমন অজানা আতংকে দিন কাটছে জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের। কৃষকদের বুক দুরুদুরু কাপছে। ফসল হারানোর আশংকায় কৃষকদের মধ্যে বিরাজ করছে বোবা কান্না। পানি না সরলে এ বছর নিশ্চিত ডুবে যাবে বিল ও ঘরবাড়ি। কিন্তু পানি নিস্কাশন হবে কীভাবে? পানি নিস্কাশনের সকল দুয়ার বন্ধ।
উত্তরে শালিখা নদী থেকে নেমে আসা দলুয়া খাল, কুলপোতা খাল, গাবতলা খাল, তালতলা খাল, বাগডাঙ্গা খাল, পোড়া হরিন খোলাখাল, সোনা বাধাল খাল, বড়বুড়ির খাল, বলুয়া টপসহ সকল খাল প্রভাবশালীদের দখলে। পানি নিস্কাশনের জন্য এসব খালগুলো শালিখা নদী থেকে নেমে এসে বেতনার পুটিমারিতে মিলিত হয়েছে। এসব খালগুলো ছাড়া পানি নিস্কাশনের আর কোন পথ নেই। খালগুলো জনস্বার্থে এবং পানি নিস্কাশনের জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা। কিন্তু খালগুলো উন্মুক্ত নেই। কেউ মাছ ধরা পাটা দিয়ে, কেউ নেট দিয়ে কেউ আবার সরাসরি খালের এপার ওপার বাধ দিয়ে দখল করে রেখেছে। এসব খালের যতদূর চোখ যায় এতদূর তাকালে দেখা যায় পাটা আর পাটা। কোথাও নেট আর নেট। শতাধিক স্থানে রয়েছে সরাসরি মাটির বাধ। মহিষাডাঙ্গা ব্রিজ থেকে বাঁয়ে সোনাবাধাল যাবার পথে কদম ফেললেই নেট-পাটা। সোনা বাধাল ব্রিজ থেকে দক্ষিণে খাল ধরে যতদূর যাওয়া যায় ততদূর নেটপাটা। খালের কমপক্ষে ৭/৮টি পৃথকস্থানে বাধ দিয়ে প্রভাবশালীরা দখলে রেখেছে। পানি নিস্কাশনের খালে বাধ দিয়ে প্রভাবশালীরা সেখানে মাছ চাষ করছেন। খালগুলো তে বাধ ও নেটপাটা দিয়ে পানি নিস্কাশনের পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে এসব প্রভাবশালীরা।
সরকারি খালে বাঁধ ও নেটপাটা দিয়ে পানি নিস্কাশনে বাধা সৃষ্টি করার সাহস প্রভাবশালীরা পেল কোথায়? এমন প্রশ্নের উত্তরে এলাকাবাসী জানান, প্রশাসনের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এসব খালের জমি শ্রেণি পরিবর্তন করে বন্দোবস্ত দিয়েছে। প্রভাবশালীরা স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কমকর্তাকে নগদ নারায়নে খুশি করে বন্দোবস্ত নিয়ে খালগুলো সাব-লিজ দিয়েছে। সাব- লিজ নিয়ে এলাকার প্রভাবশালীরা পানি নিস্কাশনের পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। এলাকাবাসী জানান, সোনা বাধাল এলাকার বিনোদ সরকার, নিতাই সরকার, পঞ্চানন সরকার, খগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, মাস্টার কার্তিক মণ্ডল, অসীম মণ্ডল, সুধান্য সরকার, আশুতোষ সরকার, গোসাই সরকার, বিরিঞ্চি ঢালী, মনুঢালী, বিশ্বনাথ সরকার(মেম্বর), সন্যাসী সরকারসহ কতিপয় ব্যক্তি সরকারি খালে বাধ ও নেটপাটা দিয়ে পানি নিস্কাশনে চরম বাধা সৃষ্টি করছেন। খাল উন্মুক্ত করার কথা বললেই এসব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সাধারণ কৃষকদের ধমক দিয়ে বলেন, সরকারের কাছ থেকে খাল কিনে নিয়েছি। নায়েব আমাদের কাছে খাল বিক্রি করে দিয়েছে। এ খাল দিয়ে পানি সরানোর ক্ষমতা কারো নেই। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা -১(তালা-কলারোয়া) আসনের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, জলাবদ্ধতা সাতক্ষীরাবাসীর দীর্ঘদিনের সমস্যা। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, জনগণের ব্যবহৃত পানি নিস্কাশনের জন্য উন্মুক্ত খাল কখনো ইজারা কিংবা বন্দোবস্ত দেয়া যাবে না। অথচ সরকারি রাজস্ব আদায়ের নামে পানি নিস্কাশনের জন্য উন্মুক্ত খালের শ্রেণি পরিবর্তন করে দুর্নীতির মাধ্যমে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা প্রভাবশালীদের কাছে বন্দোবস্ত দিয়েছে। প্রভাবশালীরা সরকারি খাল ইজারা নিয়ে তা সাব লিজ দিয়ে। সাব লিজ গ্রহীতারা এসব খালের নেটপাটা ও বাধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। এতে পানি নিস্কাশনে চরম বাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কপোতাক্ষ ও বেতনা পাড়ের ১২ লক্ষ মানুষ চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছে। বর্ষা মৌসুম সবে শুরু। এখনো বর্ষাকাল শেষ হয়নি। কিন্তু শুরু হয়েছে জলাবদ্ধতা। ইতোমধ্যে কপোতাক্ষ শালিখা ও বেতনা পাড়ের বিলগুলো পানিতে ডুবে গেছে। শতশত কৃষকের আমনধানের বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। একটু ভারি বর্ষন হলেই বিলের পানি ঘরে ঢুকবে। সাংসদ মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, সরকারি খাল দখলদারদের কবজা থেকে মুক্ত করতে -১৫(খ) ধারায় মামলা করার বিধান রয়েছে। এছাড়া সরকারি খালে পানি নিস্কাশনে বাধা সৃষ্টিকারী বাধ-নেট-পাটা উচ্ছেদে প্রশাসন টাস্ক ফোর্স গঠন করে ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান পরিচালনা করতে পারেন। দু’পাঁচজনকে ভ্রাম্যমান আদালতে সাজা দিলে খাল উন্মুক্ত হতে সময় লাগবে না।
তিনি আরো বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারনে সাতক্ষীরায় মানবসৃষ্ট জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। যে বিলগুলো নদী থেকে ৭/৮ ফুট ছিলো সে বিলের খাল ও নদীর সংযোগ স্থলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যে স্লুইস গেট নির্মান করেছে তা বিল থেকে ৭/৮ ফুট উচু। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত স্লুইস গেট নির্মানের ফলে নদী ও খালগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। সাতক্ষীরার প্রত্যেকটি নদী পাউবোর কারনে অপমৃত্যুর কবলে পড়ছে। শালিখা নদী থেকে পুটিমারি পর্যন্ত সকল খালের নেটপাটা ও বাধ উচ্ছেদে তিনি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার দাবি জানান।
এব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারি খাল উন্মুক্ত করতে শনিবার জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় জেলার প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া মুস্তফা লুৎফুল্লাহ ও সদর আসনের সাংসদ মীর মোস্তাক আহমেদ রবির উপস্থিতিতে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারি খালের বাধ নেট পাটা উচ্ছেদ অভিযানে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করবেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ বিষয়টি মনিটরিং করবেন। এক প্রশ্নে জবাবে জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বলেন, কোনো টাস্কফোর্স গঠন করা হয়নি। তবে পানি নিস্কাশনে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।



মন্তব্য চালু নেই