ছয় মাসে তারানার যত উদ্যোগ

গত বছরের ১৪ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান অ্যাডভোকেট তারানা হালিম। ১৬ জুলাই এ বিভাগে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর থেকে অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) কার্যক্রম, মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক বৃদ্ধি, ইন্টারনেটের মূল্য কমানো, ইন্টারনেট নিরাপত্তা, টেলিটকে গতি বাড়ানো, বেসরকারি অপারেটর রবি ও এয়ারটেল একীভূত করার কাজ হাতে নেন।

এছাড়া মোবাইল সিম ও রিম কার্ড নিবন্ধনে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি তথা আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার পদ্ধতি চালু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য চুক্তি, আপত্তিকর স্ট্যাটাস নির্মূলে ফেসবুকে বাংলা অনুবাদক নিয়োগ, ফোরজি চালুসহ আরো কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেন প্রতিমন্ত্রী।

এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ কার্যকর করা হয়েছে। বাকি উদ্যোগগুলো চলতি বছরেই কার্যকর হবে বলে আশা প্রকাশ করছে বিটিআরসি।

মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) কার্যক্রম: ২০১২ সালে প্রথম একই নম্বরে সব অপারেটরের সেবা পাওয়ার জন্য মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয় বিটিআরসি। ২০১২ সালে সর্বপ্রথম এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে এ কাজের গতি হারিয়ে যায়। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এ বিভাগে দায়িত্ব নেন তারানা হালিম। আরো প্রতিযোগিতামূলক, স্বচ্ছতা ও সেবার মান নিশ্চিত করতে মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) লাইসেন্স নিলামের পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন তিনি।

এরইমধ্যে এমএনপি সংক্রান্ত লাইসেন্সিং গাইডলাইনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শিগগিরই লাইসেন্সের নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। এতে ৩০ টাকায় ৪৫ দিন এক নম্বরে সব অপারেটরের সেবা পাবেন গ্রাহকরা। একই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে কয়েকটি মানদণ্ড যুক্ত করে মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) নীতিমালার সংশোধিত খসড়া চূড়ান্ত করেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

নিরাপত্তার স্বার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ: নিরাপত্তাজনিত কারণে গত ১৮ নভেম্বর ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, লাইন, ট্যাঙ্গো, হ্যাঙ্গআউট, স্কাইপি, ইমোসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয় সরকার। প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া আর কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা হবে না বলে জানিয়ে সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো খুলে দেন প্রতিমন্ত্রী। বন্ধের ২২ দিন পর ১০ ডিসেম্বর ফেসবুক চালু হয়। ২৬ দিন পর ১৪ ডিসেম্বর খুলে দেওয়া হয় বাকি অ্যাপগুলো।

আঙ্গুলের ছাপে সিম নিবন্ধন: অনিবন্ধিত সিমকার্ড ব্যবহার করে মুঠোফোনে হুমকি দিয়ে, জঙ্গিবাদ চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইল, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এড়াতে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক বৈঠকে সিম নিবন্ধন ও পুন:নিবন্ধনের উদ্যোগের কথা জানান অ্যাডভোকেট তারানা হালিম। ৮ সেপ্টেম্বর বিটিআরসিকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে চিঠি দেওয়া হয়।

এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিটিআরসিতে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় গত ২১ অক্টোবর পরীক্ষামূলকভাবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির উদ্বোধন করেন। এরপর ১ নভেম্বর থেকে মোবাইল অপারেটরগুলোর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে ২০১০ সালে প্রথম সিম নিবন্ধনের উদ্যোগ নিলেও অজ্ঞাত কারণে তা থমকে যায়। তবে সারা দেশে ছয়টি অপারেটরের রিটেইলার পর্যায়ে ৮১ হাজার ৫০০টি ডিভাইস দিয়ে আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি।

মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক বৃদ্ধি: গত এক বছরে দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় এক কোটি ও ইন্টারনেট গ্রাহক বেড়েছে ৯০ লাখ। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এ সেক্টরে দায়িত্ব নিয়ে এর অগ্রগতিতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। বর্তমানে মোবাইল গ্রাহক ১৩ কোটি ১৯ লাখ ৯৬ হাজার। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারী পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার।

ইন্টারনেটের মূল্য কমানো: দাম নির্ধারণ করে দিয়ে নয়, বরং অপারেটরগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় বিটিআারসি। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দু’মাসের মধ্যে এ পদক্ষেপ নেন তিনি।

বিটিআরসি বলছে, দাম কমেছে, ধাপে ধাপে দাম আরো কমিয়ে আনা হবে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমানোর জন্য গত এক বছরে মোবাইল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মূল্য ৩০ শতাংশেরও বেশি কমানো হয়েছে।

ইন্টারনেট নিরাপত্তা: ইন্টারনেটের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ জানিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। বিটিআরসি বিভাগে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ইন্টারনেটের নিরাপত্তা নিয়ে নানা উদ্যোগ নেন তিনি। সিম নিবন্ধন, ফেসবুকে বাংলা অনুবাদক নিয়োগ, সেট নিবন্ধনসহ নানা উদ্যোগ নেন প্রতিমন্ত্রী।

টেলিটক: গত ১০ বছর ধরে শুধু লোকসান গুনতে হয়েছে সরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটককে। বর্তমানে এর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকায়। তারানা হালিম দায়িত্ব নিয়ে এ অপারেটরের লোকসান কমিয়ে এর গতি বৃদ্ধি, বিটিসিএলের সঙ্গে এ সংযোগ স্থাপন, নতুনভাবে বাজারজাতকরণসহ নানা উদ্যোগ নেন।

ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে রি-ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে আগামী ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যেই টেলিটক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তারানা হালিম।

ডাক বিভাগ: আগে মেইল পরিবহনের জন্য ট্রেন ও লঞ্চের ওপর বেশি নির্ভর করতে হতো। ধীরগতির কারণে এ বিষয়ক সেবা পেতে বিলম্ব হতো। নতুন বছরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সেবার মান উন্নয়ন, সেবাকে সহজলভ্য করা, নিরাপদ ও সম্প্রসারণ- এই চারটি নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথাও জানান তিনি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নতুন ১১৮টি মেইল গাড়ি কেনা হচ্ছে। পাশাপাশি এসব গাড়ির ২০ শতাংশ চালাবে নারীরা।

তিনি আরো জানান, ডাক বিভাগের জন্য যে ইলেক্ট্রনিক কার্ডটি রয়েছে সেটা আরো উন্নত করা হচ্ছে, যেটি এটিএম বুথে ব্যবহার করা যায়। ডাক অধিদফতরের মাধ্যমে মোবাইল মানিঅর্ডার সার্ভিস, ক্যাশ কার্ড চালু হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ই-সেবা পৌঁছে দিতে আট হাজার ৫০০টি গ্রামীণ ডাকঘরকে ই-সেন্টারে রুপান্তরের প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন হাজার ৫০০টি ডাকঘরে পোস্ট ই-সেন্টার চালু করা হয়েছে।

এছাড়া আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে আরো দেড় হাজার ও ২০১৭ সালের ৩০ জুন অবশিষ্ট তিন হাজারসহ সর্বমোট আট হাজার ৫০০টি ডাকঘরে পোস্ট-ই-সেন্টার চালু হবে বলে বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়।

অবৈধ ‍ভিওআইপি: শপথ নেওয়ার পর প্রথম দিনেই অবৈধ ভিওআইপি নিরসনে দৃঢ়তা ব্যক্ত করেন তারানা হালিম। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা রুখতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তাগিদ দেন। সরকারও এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তারানা হালিম প্রতিনিয়তই এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানায় বিটিআরসি।

রবি ও এয়ারটেল একীভূত হওয়া: গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রবি আজিয়াটা ও এয়ারটেল বাংলাদেশের একীভূত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন প্রতিমন্ত্রী। তবে বিষয়টি কার্যকর হতে কয়েক মাস লাগবে বলে জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন: ১ নভেম্বর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য ‘থেলস এলেনিয়া স্পেন ফ্রান্স’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে বিটিআরসি। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হবে। এর সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর মাধ্যমে দেশের টেলিকম ও সম্প্রচার সেবা থেকে শুরু করে ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে বলে বিটিআরসি জানায়।

ফেসবুকে বাংলা অনুবাদক নিয়োগ: সম্প্রতি ফেসবুকে আপত্তিকর ‘কনটেন্ট ফিল্টারিং’য়ের জন্য বাংলা ভাষার অনুবাদ করতে অনুবাদক নিয়োগ দিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এর আগে সরকার ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ক একটি চিঠি দেয়।এ সিদ্ধান্তের ফলে ফেসবুকে বাংলা ভাষায় পোস্ট করা আপত্তিকর স্ট্যাটাস ও মন্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফিল্টারিং করা যাবে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিটিআরসি থেকে এরইমধ্যে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।

সিম নিবন্ধনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি): একজনের একাধিক সিম থাকায় কত সিম সক্রিয় আর কতটা নিষ্ক্রিয় তা বের করা কঠিন। আবার এর মধ্যে কোনো সিম নিবন্ধিত, কোনো সিম নিবন্ধিত নয়। এর কারণে এখনও অনেকেই অপরাধের আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। সেসব ঠেকাতেই সিম নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি। এর জন্য এনআইডির সঙ্গে একটি চুক্তিও কার্যকর করা হয়। যার মাধ্যমে একটি এনআইডিতে ২০টি সিমকার্ড সীমাবদ্ধ করে দেয় বিটিআরসি। ২০ ডিসেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ক নির্দেশনা জারি করে।

ফোর জি: চলতি বছরের প্রথম দিনেই দেশে ফোর জি ইন্টারনেট সেবা চালুর ঘোষণা দেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। ১ জানুয়ারি সচিবালয়ে এর জন্য তরঙ্গ নিলামের ঘোষণা দেন তিনি। এছাড়া ২.৫-জি সম্প্রসারণ ও পুরো দেশকে পূর্ণাঙ্গ থ্রি-জির আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।



মন্তব্য চালু নেই