ছবির মানুষটি ১৫০ জন সন্তানের জননী, তাও আবার বাংলাদেশের!

চাপাতির জন্য বেহেস্ত না ১৫০ সন্তানের জননীর জন্য বেহেস্ত !

ছবির মানুষটি ১৫০ জন সন্তানের জননী! তাও আবার বাংলাদেশের! তিনি এখনও সুস্থ আছেন এবং তাঁর সবগুলো সন্তানকে সুস্থ রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা ১৮০০০ মাখলুক সৃষ্টি করেছেন। ১৭৯৯৯ টি মাখলুক সৃষ্টিকরা হয়েছে মানুষের উপকারের জন্য। কিন্তু সেই মানুষের কাজ কী? ভদ্র মহিলার পরিচয়টা একটু পরেই বলি। তার আগে নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নেই যা অনেকের জীবনেই ঘটেছে।

ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় অনেক নামকরা হুজুরের ওয়াজ শুনেছি। আমাদের বাড়ির পাশে একটি আলিয়া মাদ্রাসা আছে অনেক পুরোনো। সেই মাঠেই হুজুররা ওয়াজ করতে আসতেন শীতের মৌসুমে শীতের পাখির মত। ওয়াজে কত রকমের ভাল ভাল কথা বলা হত তার কোনো হিসেব নেই।

বিশেষ করে এতিম দুঃখীদের কথা বর্ণনা করার সময় হুজুর যেমন ফুপিয়ে কাদতেন ঠিক তেমনি শ্রোতারাও ফুপিয়ে কাদতেন। আমি কেদেছি যে কতবার তাও মনে নেই! ওয়াজ শেষে যাওয়ার সময় যখন দেখতান এই হুজুরকে তৎকালীন ২০ হাজার টাকা সম্মানির বিনিময়ে চুক্তি করে আনা হয়েছে তখনই মনটা ভেঙে যেত। হুজুর নিশান গাড়িতে করে চলে যেতেন হাজার রকম খাবার আর উপহার পেয়ে।

আর ওয়াজের মাঠে পড়ে থাকতো তাঁর কথাগুলো! কারণ ওয়াজ যিনি করেছেন আর আমরা যারা শুনেছি তারা অধিকাংশই ওয়াজ শুনার পাগল কিন্তু কাজের কাজ করতাম না। ‘ওয়াজ করেন হুজুর সারারাত, কিন্তু নামাজ পড়তাম না!’

মৌসুমী ওয়াজে সমাজের কতটুকু উপকার তা আল্লাহপাক ভাল জানেন। আমি বড় হয়ে এই ওয়াজগুলোর আর কোনো মানে খুজে পাইনি। কারণ টাকা ছাড়া কেউ ওয়াজ করতে আসেন না। এখন আবার ওয়াজের ধরন পাল্টে গেছে! এখন ওয়াজ হয় শক্তির বিবেচনায়, ক্ষমতা মাথায় রেখে।

আরেক ধরনে বেহেস্তে যাওয়ার চাবি বের হয়েছে তা হলো ‘চাপাতি’। ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, মানন সেবা কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই যদি আমার আপনার হাতে একটি ‘চাপাতি’ থাকে। ঐ চাপাতিই আপনাকে-আমাকে পৌছে দিবে বেহেস্তে যেখানে মামানীরা নিজের পালা দেশী মুরগী রেধে আপনার-আমার জন্য অপেক্ষা করছেন! শর্ত হচ্ছে এই চাপাতি দিয়ে মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করতে হবে তাহলে বেহেস্তের দরজা খুলে যাবে! ফেরেস্তারা চাপাতি জিহাদিদের জন্য বেহেস্তকে অন্য রকম ভাবে সাজিয়ে রেখেছেন! সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে এসব বীর চাপাতিওয়ালাদের পুরস্কার দিবেন! কারণ এত বড় মহৎ কাজের পুরস্কার সৃষ্টিকর্তা নিজ হাত ছাড়া কাউকে দিয়ে দিতে পারেন না! সে এত বড় গাজী ছিল যে, এই চাপাতি দিয়েই মানুষ খুন করে এসেছে নিখুঁতভাবে! যে মানুষকেই সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন! আমার মনে হয় বাংলাদেশের জন্য ইতোমধ্যেই আরো কয়েকটি বেহেস্ত তৈরি করা হয়েছে! সেই সব বেহেস্তে নেয়া হবে এসব চাপাতিবাজদেরকে ! অপেক্ষায় রইলাম কোন্ বেহেস্ত তাদের কপালে আছে তাই দেখার জন্য!

অথচ দেখুন, ছবির এই ভদ্র মহিলার বাড়ি টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানেই লালিত-পালিত হচ্ছে তাঁর ১৫০টি সন্তান। ছবি দেখে বুঝা যাবে না তাঁর ভেতরে আলো কতটুকু প্রসারিত। তিনি টাইটানিক স্টাইলকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। টাইটানিক ছবির নায়িকা জাহাজের সামনে যেমন দুহাত প্রসারিত করে দাড়িয়ে ছিলেন ঠিক তেমনি ভাবেই ছবি ওঠাতে তিনি পছন্দ করেন। তবে তাঁর পিছে কাউকে নিয়ে নয়। তিনি হাত প্রসারিত করে কাকে আহবান করেন তা আমি জানি না। তবে তাঁর কর্ম দেখে আমার মনে হয়েছে তিনি দুহান প্রসারিত করে সৃষ্টিকর্তাকে বলছেন, ‘তুমি আমাকে এই হৃদয়টা ভরে দাও শক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে, যেন আমি হেরে না যাই।’ মানুষটার পরিচয় জানতে চান? তাহলে শুনুন-

ছবির এই ভদ্র মহিলাকে বলতে পারেন সত্যিকারের মানুষ। তাঁর বিস্তারিত পরিচয় দেবো লেখার শেষে। ইচ্ছে করেই পরে দেবো। কারণ কষ্ট হলেও একটু পড়ুন। পাল্টে যেতে পারে আপনার চিন্তা-চেতনা। আপনিও অনুপ্রাণিত হতে পারেন ১০-২০ সন্তানের পিতা-মাতা হতে। ফেসবুকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। অনেকেই আছেন তাঁর বন্ধু তালিকায়। সেই সূত্রে আমিও । আমার বন্ধু তালিকা এখনও তিন হাজার অতিক্রম করাইনি, তবে তাকে নিয়ে গতকাল একটি স্ট্যাটার্স দেয়ার বিকেল পর্যন্ত দেখেছি অসংখ্য মানুষ রিকোস্ট পাঠিয়েছেন এবং পাঠাচ্ছেন অনবরত। মেসেস এর পর মেসেস আসছে।

তাঁর জগতটা ভিন্ন রকমের।মানুষের দুটো জগত থাকে। একটি তার কর্মজগত অন্যটি ভাবনার জগত। যারা ভাবনার জগতকে বাস্তরে রূপ দিয়ে নিভৃতে চালিয়ে যান সৃজনশীল ও আর অসহায় মানুষে জন্য কিছু করার জীবনযুদ্ধ তাদেরকে শ্রদ্ধা-সম্মান না করলে সৃষ্টিকর্তাও খুশি হন না। তেমনি একজন মানুষ এই ভদ্র মহিলা। তিনি ফেসবুকে মাঝে মাঝে নিজের ছবি পোস্ট দেন, পোস্ট দেন কবিগুরু, নজরুলসহ অন্যান্য খ্যাতিমান মানুষের কিছু কিছু উক্তি। তা পড়তে পড়তেই আমি ঢুকে পড়ি তাঁর একান্ত ভাবনার জগতের বাস্তব রূপময়তার জীবনে। ছবি দেখে বুঝা যাবে না এই ভদ্র মহিলাই সেই ভদ্র মহিলা যিনি

SSC 92 তে, HSC 94 তে L. L. B. অনার্চ 98 তে, L.L.M 2000 পাশ করেছেন।তিনিই কর্মজীবনে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত এ্যাডভোকেট। তাঁর পিতা ছিলেন একজন নামকরা, সম্মানিত বিচারপতি।নিজে যা রোজগার করেন তার প্রায় সম্পূর্ণটুকুই তিনি ব্যয় করেন তার মাদ্রাসার এতিম হাজেরদের পেছনে।যেখানে ১৫০ এতিম হাফেজ লেখা কোরআন হেফজ করছেন। এখানে কারিগরি শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে।তাঁর দুটো প্রতিষ্ঠান।দুটোই টুঙ্গীপাড়ায়।ডিসেম্বরে হাফেজদের পাগড়ি বিতরণ অনুষ্ঠান হবে। তিনি আমাকে আজ দাওয়াত করেছেন। তাঁর দাওয়াত পেয়ে আমার মরহুম পিতার কথা মনে পড়ে গেল! আমার বাবাও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বিসমিল্লাশাহ দরগা আলিয়া মাদ্রাসা ও হেফজখানা।ফরিদপুর শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দক্ষিনে। এত সুন্দর মাদ্রাসা বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। তবে লেখা-পডার মান নিয়ে আমার আগেও যেমন প্রশ্ন ছিল এখনও আছে। যদি টিএনও সাহেব হচ্ছে তার মূল পরিচালক। বর্তমানে সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন অধিকাংশই। তবে হেফজখানা চলে মানুষের দানে।

যার কথা লিখতে ছিলাম সেই ভদ্র মহিলার জীবনের পরিচয়টা মাদ্রাসার নামের মতই ইতিহাস। যারা বুঝার তারা ঠিকই বুঝবেন। তাঁর মাদ্রাসার নাম রাবিয়া খাতুন হাফিজিয়া মাদ্রাসা। প্রতিস্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। হাসপাতালের নাম “ডঃ নাজমা জেসমিন চৌধুরি দাতব্যচিকিৎসালয় ” এটা নিবন্ধিত হয়েছে। এটাও ২০০৮ সালে প্রতিস্ঠিত। ডঃ নাজমা জেসমিন চৌধুরি তাঁর ফুপু। ফুপু মারা গিয়েছেন ক্যানসারে। ফুপা জীবিত আছেন। আপনারা অনেক তাকে চিনবেন। ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ইংরেজি বিভাগের ডীন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁর ফুপু ছিলেন বাংলা বিভাগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।

একটা এতিমের পায়ে-কিংবা যদি হাতে যদি ফুলের কাটাও বিধে রক্তাক্ত হয় সেই খবর শুনে রক্তাক্ত সান্তা আপার হৃদয়। তিনি ছুটে যান মাদ্রাসায়। এরাই তো মানুষ নাকি?

তিনি এই দুটো প্র্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থে যেখানের সমস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষিত, পেশা জীবনে এ্যাডভোকেট এই ভদ্র মহিলা স্টাইল করাকে খুব পছন্দ করেন সেটা আগেই বলেছি। এটা তাদের চোখেই দোষ মনে হবে যারা সূর্য অস্ত আইনকে এখনও শ্রদ্ধাভরে মহাভক্তি করেন! শরীয়তের দৃষ্টিতে তাঁর চলাফেরার দায়িত্ব আল্লাহপাক কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেননি। তিনি যদি ধর্মীয় বিধানে কোনো অন্যায় করে থাকেন তাহলে সেই বিষয়ে কবরে তাকেই জিজ্ঞাসার করা হবে আমাকে আপনাকে নয়।

কথাগুলো লিখতাম না। কিন্তু লিখছি একটি কারণে। কারণটি হলো- কিছুদিন আগে তাঁর একটি ছবিতে একজন কুড়ি-পঁচিশ বছরের যৌবনধারী যুবক কমেন্ট করে লিখেছিলো,

‘বুড়ির আবার এত ঢঙ কিসের?’

মন্তবটি এমনি হয়ত হবে। যথার্থ মন্তব্য করে যুবকটি বুঝিয়ে দিলো তার মা কোনোদিনও বুড়ি হবেন না! আমার খুব ইচ্ছে করছিল যুবকটি সাথে বন্ধুত্ব করি। পরে চিন্তা করলাম, না থাক। মন্তব্য করা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। এমন যুবকের দ্বারা সমাজ কী পাবে তা আমার বুঝা হয়ে গেছে। আমি শুধু তাকে অনুরোধ করবো, ১৫০ নয়, ১০০ নয়, ৫০ নয়, ২৫ নয়, ১০ নয়, ৫ নয়, মাত্র ১ জন এতিমের দায়িত্ব তুমি নিজের কাধে তুলে নাও। একজন অসহায়ের পাশে দাড়াও। মাত্র একজন শিক্ষা বঞ্চিত শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব তুমি কাধে তুলে নাও। তবেই বুঝবো তোমার কুড়ি আর কোনোদিন বুড়ো-বুড়ি হবে না। কত শিয়াল-কুকুর মরে পড়ে থাকে ডোবা নালায়, রাস্তার পাশে। কেউ তাদের মনে রাখে না। কিন্তু একজন মানুষ মরে গেলে তাঁর কথা-কর্ম কেন মানুষ মনে রাখে এটা আগে তোমাকে বুঝতে হবে। তবেই বুড়িকে তোমার চোখে সুন্দর লাগবে, শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করবে। জীবন তো একটাই। তাই একটি জীবিত কুকুরের মত অনেক বছর বেঁচে থাকার কোনো দরকার নেই। পারলে একদিন হলেও সিংহের মত বেঁচে থাকো।

Shaheen Sultana Shanta​ আপনাকে সেলুট। নেপালের প্রথম নারী প্রেসিডেন্টকে যেমন গৌরবের অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, তেমনি আপনাকেও জানাচ্ছি। ভাল থাকুন বন্ধু। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে আরো আরো তৌফিক দান করুন মানুষের জন্য কিছু করার।

আমি দেখতে চাই বেহেস্ত এই ১৫০ জন এতিমের মায়ের জন্য নাকি জিহাদের নাম করে যারা চাপাতি দিয়ে মায়ের কোলগুলোকে খালি করছে তাদের জন্য! সৃষ্টিকর্তা, তুমি আমাকে অন্তত এই দৃশ্যটা দেখিও। আমি তোমার কাছে বেহেস্ত-দোযখ কিছুই চাই না। আমি দেখতে তোমাকে, তোমার বিচারকে।

লিখেছেন: রাশেদ আজাদ



মন্তব্য চালু নেই