চীনা প্রেসিডেন্টকে বরণ করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। শুক্রবার সকালে তিনি বিশেষ বিমানে ২২ ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসছেন। চীনের প্রেসিডেন্টকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বাগত জানাবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সংবর্ধনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুটি জেট চীনের প্রেসিডেন্টের বিমানকে এসকর্ট করে নিয়ে আসবে।

বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর একুশবার তোপধ্বনির পর সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস দল সফররত প্রেসিডেন্টকে গার্ড অব অনার প্রদান করবেন।

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরকে দু’দেশের সম্পর্কের মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছে চীন। ৩০ বছর পর চীনের কোনো প্রেসিডেন্ট ঐতিহাসিক সফরে এবার ঢাকায় আসছেন। শি জিনপিংকে স্বাগত জানাতে রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে বাংলাদেশ ও চীনের জাতীয় পতাকা টানানো হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় শোভা পাচ্ছে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পোট্রেট। সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। এছাড়া তিনি দু’দেশের মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করবেন।

চীনের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এক রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে আপ্যায়ন করবেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন চীনের প্রেসিডেন্ট। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এবারের বাংলাদেশ সফর তার দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিন দেশ সফরের অংশ। তিনি কম্বোডিয়া থেকে বাংলাদেশে আসছেন। শনিবার সকালে তিনি ভারতের পর্যটন নগরী গোয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। বিমানবন্দরে চীনের প্রেসিডেন্টকে বিদায় জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গোয়ায় শনি ও রোববার ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ব্রিকস নেতারা গোয়ায় বিমসটেক নেতাদের সঙ্গে একটি আউটরিচ সম্মেলনে যোগ দেবেন রোববার।

এই সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার ভারত সফরে যাচ্ছেন। ভারত সফরকালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।

চীনের প্রেসিডেন্টের সফর সম্পর্কে অবহিত করতে বৃহস্পতিবার বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ও চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ফজলুল করিমসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, অত্যন্ত নিবিড় এবং নানাবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চাশের দশকে দু’বার বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের মাধ্যমে যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল ২০১০ এবং ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে সেই সম্পর্ক আরও গভীর, নিবিড় ও ব্যাপক অংশীদারিত্বমূলক সহযোগিতায় রূপ নিয়েছে। গত চার দশক ধরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও যোগাযোগ অবকাঠামো বিনির্মাণে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য এবং প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় নেতৃত্বে চীনের নেতাদের ভূয়সী প্রশংসা ও গভীর আস্থা অর্জন করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে এগিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের প্রাজ্ঞ কূটনৈতিক পদক্ষেপে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান সম্পর্ককে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার অংশ হিসেবে ৩০ বছর পর এটাই চীনের কোনো রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২৫-এর অধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি, ভৌত অবকাঠামো সড়ক সেতু, রেল যোগাযোগ ও জলপথে যোগাযোগ এবং কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও গভীর হবে। একই সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের মধ্যে সমুদ্রসম্পদসহ দুর্যোগ মোকাবেলা, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র সংযোজিত হবে।

সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী আরও বলেন, বহু দশক পরে প্রেসিডেন্টের এই সফর শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের প্রতি আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের আস্থার প্রতীক। এই সফর বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্বের স্মারক এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পথে এক ঐতিহাসিক নবযাত্রার সূচনা করবে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আনুষ্ঠানিক বৈঠককালে তার দেশের ২৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। প্রতিনিধি দলে চীনের তিনজন স্টেট কাউন্সিলর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সংস্কার কমিশনের নির্বাহী চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশের ২৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নয়জন মন্ত্রী সফরসঙ্গী হিসেবে থাকছেন।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এক নতুন যুগে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। কেননা এ পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে সাতটি সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে। এছাড়া চীনের সহায়তায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু এবার চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিশাল অর্থায়ন করতে যাচ্ছে। এই অর্থায়নের পরিমাণ চল্লিশ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। চীনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে চীন।

চীনের অর্থনৈতিক উত্থান গোটা বিশ্বেই এক বিস্ময়। টানা ৩০ বছর ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে এই দেশটি। কিন্তু মাঝখানে এক সন্তান নীতি গ্রহণের কারণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা নিুমুখী হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে চীন কানেকটিভিটিতে বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। আর এই উদ্যোগ নেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০১৩ সালে তিনি যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন তার নাম ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশ্বের ৬৫টি দেশ সড়ক ও সমুদ্রপথে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। বাংলাদেশ, চীন, মিয়ানমার ও ভারতের মধ্যে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর নামের একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলা হচ্ছে। শি জিনপিংয়ের এবারের সফরকালে মেরিটাইম সিল্ক রোডে সংযুক্ত হওয়ার চুক্তিতে সই করার মধ্য দিয়ে চীনের ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভে’ যোগ দেবে বাংলাদেশ। এই মেরিটাইম সিল্ক রোড চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতকে সংযুক্ত করবে। এ সংক্রান্ত কাঠামো চুক্তিতে সই করার ব্যাপারে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের পরপরই বাংলাদেশের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহী হয় ওঠে চীন।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় থাকলেও দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের সূচনা হয়েছিল ২০১০ সালে শেখ হাসিনার চীন সফরের মাধ্যমে। ওই সময়ে দুই দেশের মধ্যে নিবিড় সহযোগিতা গড়ে তোলা সংক্রান্ত একটি ব্যাপকভিত্তিক চুক্তি সই হয়।

শি জিনপিং ২০১০ সালে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। চীনের এই মুহূর্তে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেন শি জিনপিং। তিনি বর্তমানে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপ দিতে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রতি জোর দিয়েছেন। এই সম্পৃক্ততার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে। চীন থেকে ঋণ নেয়ার বড় অসুবিধা হল এই ঋণের সুদের হার অনেক বেশি। শতকরা দুই শতাংশ সুদে চীন ঋণ দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ চীনকে দেড় শতাংশ হারে ঋণ দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের আট বিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। চীন প্রতি বছর নয় বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করে। এক সময় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করত ভারত। ২০০৭ সালের পর চীন সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে থাকে। তার বিপরীতে বাংলাদেশ চীনে রফতানি করে এক বিলিয়ন ডলারের কম পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হবে।

বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ পেতে চীন খুবই আগ্রহী। তবে বাংলাদেশ এককভাবে কোনো দেশকে এই কাজ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পটুয়াখালীর পায়রায় এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজকে ২২টি অংশে ভাগ করেছে বাংলাদেশ। চীন এক্ষেত্রে যে কোনো অংশের কাজ পেতে পারে।



মন্তব্য চালু নেই