চার বছরেও রানা প্লাজার ৩ মামলার কোনো কুল-কিনারা হয়নি

সাভারের রানা প্লাজা ধসের চার বছরেও হত্যাসহ পৃথক তিনটি মামলার কোনো কুল-কিনারা হয়নি। চার বছর আগে ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে।যেটি ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি পায়।

ওই দুর্ঘটনার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ২৯১ জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তারা সবাই ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।

তিন মামলার মধ্যে হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় এক বছর আগে অভিযোগ গঠন হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার অভিযোগ গঠন সংক্রান্ত শুনানি হলেও আদেশ দেননি আদালত।

এদিকে দীর্ঘদিনেও চাঞ্চল্যকর তিন মামলার বিচার শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক ফাতেমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, সবার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এমন দুর্ঘটনার বিচার দ্রুত হওয়া উচিত ছিল। গরিব বলে সবক্ষেত্রেই আমাদের অবহেলার শিকার হতে হয়। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা পার পেয়ে যাবে বলেও অভিমত তার।

হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খোন্দকার আব্দুল মান্নান বলেন, প্রতি ধার্য তারিখে হত্যা মামলার সাক্ষ্য দিতে সাক্ষীরা আদালতে হাজির হন। কিন্তু মামলাটির কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় আমরা সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজার শ্রমিক হত্যা মামলাটির অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আসামিপক্ষ রিট করে হাইকোর্টে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মাসের জন্য এর কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনারুল কবির বাবুল বলেন, তিন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেছেন। রিভিশন মামলাটির আদেশ না পাওয়ায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, মামলার অন্যতম আসামি সাভারের সাবেক পৌর মেয়র রেফাত উল্লার পক্ষে করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এক বছরের জন্য মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজার তিন মামলার মধ্যে হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় এক বছর আগে অভিযোগ গঠন হয়েছে। দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠন আদেশের জন্য রয়েছে। আমরা চাই মামলা তিনটি যেন দ্রুত শেষ হয়। ন্যায়-অন্যায় আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ হবে।

শ্রমিক হত্যা মামলা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। ভবনের নিচে চাপা পড়েন সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক শ্রমিক। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

ওই ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা মামলা দায়ের করেন।

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে মামলাটি ৭ মে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে। অভিযোগ গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

ইমারত নির্মাণ আইনে মামলা
একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় মামলাটি করেন।

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১৩০ জনকে।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে ওই আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখনও একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১৭ মে দিন ধার্য রয়েছে।

দুই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন) এ টি এম মাসুদ রেজা, প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসাইন, সাভার পৌরসভার মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার সাবেক টাউন প্ল্যানার ফারজানা ইসলাম, লাইসেন্স পরিদর্শক মো. আব্দুল মোত্তালিব, পৌরসভার সাবেক সচিব মর্জিনা খান, সাবেক সচিব মো. আবুল বাশার, ফ্যান্টম এপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান।

নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণে দুর্নীতি মামলা
রানা প্লাজা ধসের পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সাভার থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে কমিশন। ভবনটি সোহেল রানার বাবার নামে হওয়ায় ওই সময় মূল অভিযুক্ত সোহেল রানাকে বাদ দিয়ে তার বাবা-মাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। তদন্তে সোহেল রানাই ভবনের মূল দেখভালকারী ছিল- প্রমাণ হলে চার্জশিটে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক এস এম মফিদুল ইসলাম ওই বছরের ১৬ জুলাই সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা ও দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় চার্জশিট দাখিল করেন। এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষে ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক এম আতোয়ার রহমান গত বছরের ৬ মার্চ দুদকের দেয়া অভিযোগপত্রে ত্রুটি থাকায় পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। পুনঃতদন্ত শেষে চলতি বছরের শুরুতে ফের একই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে দুদক।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ এম আতোয়ার রহমানের আদালতে অভিযোগ গঠনের আদেশের জন্য আগামী ৮ মে দিন ধার্য রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই